নবী অাকরাম সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়া সাল্লাম এর চরিত্র ও গুনাবলী: পর্ব- ১

নবীজির চারিত্রিক গুণাবলি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সুন্দর আকৃতিবিশিষ্ট, সৌরভে সুবাসিত, গঠনে মধ্যম, দেহে সবল, মস্তক ছিল বড়, দাড়ি ছিল ঘন, হস্ত ও পদ-দ্বয় ছিল মাংসল, উভয় কাঁধ ছিল বড়, চেহারায় ছিল রক্তিম ছাপ, নেত্র দ্বয় ছিল কালো, চুল ছিল সরল, গণ্ডদ্বয় কোমল। চলার সময় ঝুঁকে চলতেন, মনে হত যেন উঁচু স্থান হতে নিচুতে অবতরণ করছেন। যদি কোন দিকে ফিরতেন, পূর্ণ ফিরতেন। মুখমণ্ডলের ঘাম সুঘ্রাণের কারণে মনে হত সিক্ত তাজা মুক্তো। তার উভয় কাঁধের মাঝখানে নবুয়তের মোহর ছিল-অর্থাৎ সুন্দর চুল ঘেরা গোশতের একটি বাড়তি অংশ। নবীজীর চরিত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সুমহান, পূর্ণ ও শ্রেষ্ঠতর চরিত্রে সুসজ্জিত, সবদিকে অতুলনীয়। মহান আল্লাহ বলেন :— এবং নিশ্চয় তুমি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত। (সূরা কালাম ৪০) আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উৎকৃষ্ট চরিত্রের কতিপয় দিক-বিশেষতঃ তাঁর শিষ্টাচার সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করছি, যাতে আমরা তা অনুকরণ করতে পারি, আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারি, মুসলিম ভাইদেরকে এর প্রতি আহ্বান করতে পারি। মহান আল্লাহ বলেন : যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মাঝে উত্তম নমুনা রয়েছে। (সূরা আহযাব: ২১। সহিহ হাদিসে আছে – ﺃﻛﻤﻞ ﺍﻟﻤﺆﻣﻨﻴﻦ ﺇﻳﻤﺎﻧﺎ ﺃﺣﺴﻨﻬﻢ ﺃﺧﻼﻗﺎً . ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺘﺮﻣﺬﻯ : 2537 সবচেয়ে সুন্দর চরিত্রবান ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা পূর্ণ ঈমানদার। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল¬ম আরো বলেন :— ﺇﻥ ﻣﻦ ﺃﺣﺒﻜﻢ ﺇﻟﻲ ﻭﺃﻗﺮﺑﻜﻢ ﻣﻨﻲ ﻣﺠﻠﺴﺎً ﻳﻮﻡ ﺍﻟﻘﻴﺎﻣﺔ ﺃﺣﺴﻨﻜﻢ ﺃﺧﻼﻗﺎً . ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺘﺮﻣﺬﻯ : 1941 তোমাদের মাঝ থেকে সবচেয়ে বেশি চরিত্রবান ব্যক্তিই আমার নিকট অধিক প্রিয় এবং কেয়ামত দিবসে সর্বাপেক্ষা আমার অধিক নিকটে উপবেশনকারী। (তিরমিজী) নবীর কতিপয় চরিত্র নিম্নে উল্লেখ করা হল- ১- তাকওয়া ও আল্লাহর ভীতি :— রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাপেক্ষা তাকওয়া অবলম্বনকারী ছিলেন। গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :— ﺇﻧﻲ ﻷﻋﻠﻤﻜﻢ ﺑﺎﻟﻠﻪ، ﻭﺃﺷﺪّﻛﻢ ﻟﻪ ﺧﺸﻴﺔ . আল্লাহ সম্পর্কে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি অবগত এবং আল্লাহকে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি ভয় করি। স্বয়ং সাহাবায়ে কেরাম একথার সমর্থনে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা:) বলেন :— আমরা গণনা করে দেখতাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মজলিসে একশত বার নিম্নের দুআটি পড়তেন :— ‏(ﺭﺏ ﺍﻏﻔﺮ ﻟﻲ، ﻭﺗﺐ ﻋﻠﻲ، ﺇﻧﻚ ﺃﻧﺖ ﺍﻟﺘﻮﺍﺏ ﺍﻟﺮﺣﻴﻢ ‏) হে আমার রব, তুমি আমাকে ক্ষমা কর, এবং আমার তাওবা কবুল কর, নিশ্চয় তুমি তাওবা কবুলকারী, দয়াশীল। নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় রবের অনুগত ছিলেন। তিনি মেনে চলতেন তার আদেশ-নিষেধ। আমলে সালেহ বেশি করতেন। আয়েশা (রা:) নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবস্থার বিবরণ দিয়ে বলেন :— ﻛﺎﻥ ﻋﻤﻞ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﺩﻳﻤﺔ، ﺃﻳﻜﻢ ﻳﻄﻴﻖ ﻣﺎ ﻳﻄﻴﻖ ؟ ﻛﺎﻥ ﻳﺼﻮﻡ ﺣﺘﻰ ﻧﻘﻮﻝ ﻻ ﻳﻔﻄﺮ، ﻭﻳﻔﻄﺮﺣﺘﻰ ﻧﻘﻮﻝ ﻻ ﻳﺼﻮﻡ، ﻭﻛﻨﺖ ﻻ ﺗﺸﺎﺀ ﺃﻥ ﺗﺮﺍﻩ ﻣﻦ ﺍﻟﻠﻴﻞ ﻣﺼﻠﻴﺎً ﺇﻻ ﺭﺃﻳﺘﻪ ﻣﺼﻠﻴﺎً، ﻭﻻ ﻧﺎﺋﻤﺎً ﺇﻻ ﺭﺃﻳﺘﻪ ﻧﺎﺋﻤﺎً . ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺘﺮﻣﺬﻯ : 700 নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমল ছিল ধারাবাহিক। তিনি যা পারতেন তোমাদের কেউ কি তা পারবে ? তিনি সিয়াম পালন করতেন- এমনকি আমরা বলতাম তিনি এর ধারাবাহিকতা আর পরিত্যাগ করবেন না। তিনি সিয়াম পালন বাদ দিতেন- এমনটি আমরা বলতাম তিনি আর সিয়াম পালন করবেন না। তুমি তাঁকে রাত্রে সালাতরত অবস্থায় দেখতে না চাইলেও সালাতরত অবস্থায় তাঁকে দেখতে পাবে। তুমি তাঁকে রাত্রে ঘুমন্তাবস্থায় দেখতে না চাইলেও ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁকে দেখতে পাবে। আউফ বিন মালেক (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :— ﻛﻨﺖ ﻣﻊ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻟﻴﻠﺔ، ﻓﺎﺳﺘﺎﻙ ﺛﻢ ﺗﻮﺿﺄ، ﺛﻢ ﻗﺎﻡ ﻳﺼﻠﻲ، ﻓﻘﻤﺖ ﻣﻌﻪ، ﻓﺒﺪﺃ ﻓﺎﺳﺘﻔﺘﺢ ﺍﻟﺒﻘﺮﺓ، ﻓﻼ ﻳﻤﺮ ﺑﺂﻳﺔ ﺭﺣﻤﺔ ﺇﻻ ﻭﻗﻒ ﻓﺴﺄﻝ، ﻭﻻ ﻳﻤﺮ ﺑﺂﻳﺔ ﻋﺬﺍﺏ ﺇﻻ ﻭﻗﻒ ﻓﺘﻌﻮﺫ، ﺛﻢ ﺭﻛﻊ ﻓﻤﻜﺚ ﺑﻘﺪﺭ ﻗﻴﺎﻣﻪ ﻳﻘﻮﻝ : ﺳﺒﺤﺎﻥ ﺫﻱ ﺍﻟﺠﺒﺮﻭﺕ ﻭﺍﻟﻤﻠﻚ ﻭﺍﻟﻤﻠﻜﻮﺕ ﻭﺍﻟﻌﻈﻤﺔ، ﺛﻢ ﺳﺠﺪ ﻭﻗﺎﻝ ﻣﺜﻞ ﺫﻟﻚ، ﺛﻢ ﻗﺮﺃ ﺁﻝ ﻋﻤﺮﺍﻥ ﺛﻢ ﺳﻮﺭﺓ ﺳﻮﺭﺓ ﻳﻔﺼﻞ ﻣﺜﻞ ﺫﻟﻚ . ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﻨﺴﺎﺋﻰ : 1120 এক রজনিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর সাথে ছিলাম, তিনি মিসওয়াক করলেন, অতঃপর ওজু করলেন, এরপর দাঁড়িয়ে সালাত আরম্ভ করলেন, আমি ও তাঁর সাথে দাঁড়ালাম, তিনি সূরা বাকারা পড়া শুরু করলেন, দয়া সংবলিত আয়াত পড়া মাত্র থেমে প্রার্থনা করলেন। শাস্তির অর্থ সংবলিত আয়াত পড়া মাত্র থেমে মহান আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইলেন। অতঃপর দাঁড়ানোর পরিমাণ রুকুতে অবস্থান করলেন, এবং পড়তে লাগলেন : – মহা প্রতাপশালী, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, রাজত্ব ও মহত্ত্বের অধিকারী সত্তার পবিত্রতা ও মহিমা ও ঘোষণা করছি।” অতঃপর সেজদা করলেন, এবং অনুরূপ পড়লেন, এরপর আলে- ইমরান পড়লেন। অতঃপর একেকটি সূরা পড়তেন থেমে। আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : – ﻛﺎﻥ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﺇﺫﺍ ﺻﻠﻰ ﻗﺎﻡ ﺣﺘﻰ ﺗﻔﻄﺮ ﺭﺟﻼﻩ، ﻓﻘﻠﺖ ﻳﺎ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺃﺗﺼﻨﻊ ﻫﺬﺍ، ﻭﻗﺪ ﻏﻔﺮ ﻟﻚ ﻣﺎ ﺗﻘﺪﻡ ﻣﻦ ﺫﻧﺒﻚ ﻭﻣﺎ ﺗﺄﺧﺮ؟ ﻓﻘﺎﻝ : ‏( ﻳﺎ ﻋﺎﺋﺸﺔ، ﺃﻓﻼ ﺃﻛﻮﻥ ﻋﺒﺪﺍً ﺷﻜﻮﺭﺍً ‏) . ﺭﻭﺍﻩ ﺃﺣﻤﺪ : 23700 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাত আদায় করতেন দাঁড়িয়ে আদায় করতেন এমনকি তাঁর উভয় পা ফেটে যেত, আমি বললাম-হে রাসূলুল্লাহ ! কেন আপনি এমন করছেন অথচ আপনার পূর্বের ও পশ্চাতের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে ? জওয়াবে তিনি বললেন, হে আয়েশা আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না ? ২- দানশীলতা :— নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দানশীলতা, উদারতা ও বদান্যতায় ছিলেন সর্বোচ্চ উদাহরণ। জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা:) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন :- ﻣﺎ ﺳﺌﻞ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﺷﻴﺌﺎً ﻗﻂ ﻓﻘﺎﻝ : ﻻ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট কিছু চাওয়া হলে তিনি না বলতেন না। আনাছ বিন মালেক (রা:) বলেন :- ﻣﺎ ﺳﺌﻞ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﺷﻴﺌﺎ ﺇﻻ ﺃﻋﻄﺎﻩ، ﻓﺴﺄﻟﻪ ﺭﺟﻞ ﻓﺄﻋﻄﺎﻩ ﻏﻨﻤﺎً ﺑﻴﻦ ﺟﺒﻠﻴﻦ، ﻓﺄﺗﻰ ﺍﻟﺮﺟﻞ ﻗﻮﻣﻪ، ﻓﻘﺎﻝ ﻟﻬﻢ : ﻳﺎ ﻗﻮﻡ ﺃﺳﻠﻤﻮﺍ، ﻓﺈﻥ ﻣﺤﻤﺪﺍً ﻳﻌﻄﻲ ﻋﻄﺎﺀ ﻣﻦ ﻻ ﻳﺨﺎﻑ ﺍﻟﻔﺎﻗﺔ . ﺭﻭﺍﻩ ﻣﺴﻠﻢ : 4275 রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট কিছু চাওয়া হলে তিনি দিয়ে দিতেন। এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট চাইল, তিনি তাকে দুই পাল ছাগলের মধ্য থেকে এক পাল দিয়ে দিলেন, সে লোক নিজ গোত্রে এসে বলল, হে গোত্রের লোকেরা! তোমরা মুসলমান হয়ে যাও, কেননা “মোহাম্মদ এমন ব্যক্তির ন্যায় দান করে যে দারিদ্র্যের ভয় করে না” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বদান্যতার ব্যাপারে আব্বাস (রা:) উক্তিই যথেষ্ট। তিনি বলেন :- ﻛﺎﻥ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﺃﺟﻮﺩ ﺍﻟﻨﺎﺱ، ﻭﻛﺎﻥ ﺃﺟﻮﺩ ﻣﺎ ﻳﻜﻮﻥ ﻓﻲ ﺭﻣﻀﺎﻥ، ﺣﻴﻦ ﻳﻠﻘﺎﻩ ﺟﺒﺮﻳﻞ ﺑﺎﻟﻮﺣﻲ، ﻓﻴﺪﺍﺭﺳﻪ ﺍﻟﻘﺮﺁﻥ، ﻓﻠﺮﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﺃﺟﻮﺩ ﺑﺎﻟﺨﻴﺮ ﻣﻦ ﺍﻟﺮﻳﺢ ﺍﻟﻤﺮﺳﻠﺔ . ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺒﺨﺎﺭﻱ : 3290 রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মাঝে অধিকতর দানশীল। তিনি রমজান মাসে অধিক দান করতেন-যখন জিবরাইল তাঁর নিকট ওহি নিয়ে আসতেন, তাঁকে কোরআন শিক্ষা দিতেন। নিঃসন্দেহে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুক্ত বায়ুর চেয়ে অধিক দানশীল ছিলেন। (মুক্ত বায়ুর তুলনায় রাসূলের দানশীলতা অধিক-এ তুলনার মর্মার্থ হচ্ছে, বায়ু মুক্ত হলেও তার যেমন কিছু কিছু দৌর্বল্য থাকে-যেমন সে পৌঁছতে পারে না আবদ্ধ ঘরে-রাসূলের দানশীলতার তেমন কোন দৌর্বল্য নেই। তার দানশীলতা পৌঁছে যেত সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে।) ৩- সহনশীলতা সহনশীলতায় ও ক্রোধ-সংবরণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বোচ্চ আদর্শ। কখনো তাঁর পক্ষ হতে মন্দ কথন ও কর্ম প্রকাশ পায়নি, নির্যাতন-অবিচারের শিকার হলেও কখনো প্রতিশোধ নেননি। কখনো কোন সেবক বা স্ত্রীকে প্রহার করেননি। আয়েশা (রা:) বলেন :- ﻣﺎ ﺭﺃﻳﺖ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻣﻨﺘﺼﺮﺍ ﻟﻤﻈﻠﻤﺔ ﻇﻠﻤﻬﺎ ﻗﻂ، ﻣﺎ ﻟﻢ ﺗﻜﻦ ﺣﺮﻣﺔ ﻣﻦ ﻣﺤﺎﺭﻡ ﺍﻟﻠﻪ، ﻭﻣﺎ ﺿﺮﺏ ﺑﻴﺪﻩ ﺷﻴﺌﺎ ﻗﻂ ﺇﻻ ﺃﻥ ﻳﺠﺎﻫﺪ ﻓﻲ ﺳﺒﻴﻞ ﺍﻟﻠﻪ، ﻭﻣﺎ ﺿﺮﺏ ﺧﺎﺩﻣﺎ ﻗﻂ ﻭﻻ ﺍﻣﺮﺃﺓ . ﺭﻭﺍﻩ ﻣﺴﻠﻢ : 4296 রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে -আল্লাহর নিষিদ্ধ সীমা-রেখা লঙ্ঘন না হলে-কখনো নিজের প্রতি জুলুম-নির্যাতনের কোন প্রতিশোধ নিতে আমি দেখিনি। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা ব্যতীত তিনি কখনো কোন কিছুকে স্বীয় হস্ত দ্বারা প্রহার করেননি। এবং তিনি কখনো কোন সেবক বা স্ত্রীকে প্রহার করেননি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহনশীলতার সমর্থনে কয়েকটি ঘটনা নিম্নে উল্লেখ করা হল – উহুদ যুদ্ধে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর মুখমণ্ডল আঘাত প্রাপ্ত হল, কয়েকটি দাঁত ভেঙে গেল, মাথায় পরিধেয় শিরস্ত্রাণ খণ্ড- বিখণ্ড হল, তারপরেও তিনি কোরাইশদের বিরুদ্ধে বদ-দোআ করেননি। বরং তিনি বলেছেন – ﺍﻟﻠﻬﻢ ﺍﻏﻔﺮ ﻟﻘﻮﻣﻲ ﻓﺈﻧﻬﻢ ﻻ ﻳﻌﻠﻤﻮﻥ . ﺭﻭﺍﻩ ﻣﺴﻠﻢ : 3218 হে আল্লাহ ! আমার জাতিকে ক্ষমা কর, কেননা তারা জানে না। জনৈক বেদুইন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চাদর শক্তভাবে টান দিলে তাঁর গলায় দাগ হয়ে গেল। তিনি বললেন : – ﺍﺣﻤﻞ ﻟﻲ ﻋﻠﻰ ﺑﻌﻴﺮﻱّ ﻫﺬﻳﻦ ﻣﻦ ﻣﺎﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﺬﻱ ﻋﻨﺪﻙ، ﻓﺈﻧﻚ ﻻ ﺗﺤﻤﻞ ﻣﻦ ﻣﺎﻟﻚ ﻭﻣﺎﻝ ﺃﺑﻴﻚ আল্লাহর যে সব মাল তোমার কাছে আছে আমার এই দু উটের উপর আমার জন্য তা তুলে দাও। কেননা তুমি আমার জন্য তোমার সম্পদ ও তোমার পিতা-মাতার সম্পদ তুলে দেবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে আচরণে সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন, তিনি শুধু বললেন : – ﺍﻟﻤﺎﻝ ﻣﺎﻝ ﺍﻟﻠﻪ، ﻭﺃﻧﺎ ﻋﺒﺪﻩ، ﻭﻳﻘﺎﺩ ﻣﻨﻚ ﻳﺎ ﺃﻋﺮﺍﺑﻲ ﻣﺎ ﻓﻌﻠﺖ ﺑﻲ মাল হচ্ছে আল্লাহর, আমি তাঁর বান্দা। হে বেদুইন ! তোমার কাছ থেকে আমার সাথে কৃত অনাচারের কেসাস নেয়া হবে। বেদুইন বলল: না নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা¬ম বললেন : কেন ? সে বলল : – ﻷﻧﻚ ﻻ ﺗﻜﺎﻓﺊ ﺍﻟﺴﻴﺌﺔ ﺑﺎﻟﺴﻴﺌﺔ . ﺃﺑﻮﺩﺍﻭﺩ : 4145 কেননা, তুমি তো খারাপের প্রতিশোধ খারাপ দিয়ে নাও না। একথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসলেন, এবং এক উটের উপর গম অন্য উটের উপর খেজুর বহন করে দেয়ার আদেশ প্রদান করলেন। ৪- ক্ষমা প্রদর্শন : প্রতিশোধ নেয়ার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সীমা-লঙ্ঘন কারীকে মার্জনা করা একটি উদার ও মহৎ গুণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নোক্ত আল্লাহর আদেশ মান্য করত: এ-গুণে সর্বাপেক্ষা গুণান্বিত ছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :- ﺧُﺬِ ﺍﻟْﻌَﻔْﻮَ ﻭَﺃْﻣُﺮْ ﺑِﺎﻟْﻌُﺮْﻑِ ﻭَﺃَﻋْﺮِﺽْ ﻋَﻦِ ﺍﻟْﺠَﺎﻫِﻠِﻴﻦَ ﴿ 199 ﴾ ﺍﻷﻋﺮﺍﻑ তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন কর, সৎ কর্মের আদেশ দাও অজ্ঞদেরকে এড়িয়ে চলো। (সুরা আরাফ: ১১৯) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ক্ষমা প্রদর্শনের অনেক ঘটনাবলির বিবরণ বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত আছে, নীচে দুটি উল্লেখ করা হল। তিনি যখন মক্কা বিজয় করলেন, কোরাইশের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিবর্গকে তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় নতশীরে উপবিষ্ট পেলেন। তিনি তাদেরকে বললেন : – ﻳﺎ ﻣﻌﺸﺮ ﻗﺮﻳﺶ : ﻣﺎ ﺗﻈﻨﻮﻥ ﺃﻧﻲ ﻓﺎﻋﻞ ﺑﻜﻢ ؟ ﻗﺎﻟﻮﺍ : ﺃﺥ ﻛﺮﻳﻢ، ﺍﺑﻦ ﺃﺥ ﻛﺮﻳﻢ، ﻗﺎﻝ : ﻓﺎﺫﻫﺒﻮﺍ ﻓﺄﻧﺘﻢ ﺍﻟﻄﻠﻘﺎﺀ، হে কোরাইশগণ ! তোমাদের সাথে এখন আমার আচরণের ধরন সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কি ? তারা বলল : আপনি উদার মনস্ক ভাই ও উদার মনস্ক ভাইয়ের ছেলে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: যাও, তোমরা মুক্ত। তিনি তাঁর ও সাহাবায়ে কেরামের বিরুদ্ধে ঘটানো সমস্ত অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দিলেন। -রাসূলকে হত্যার উদ্দেশ্যে এক লোক আসল, কিন্তু তা ফাঁস হয়ে গেল। সাহাবিগণ বললেন : হে আল্লাহর রাসূল ! এই লোক আপনাকে হত্যা করার মনস্থ করেছে, এ-কথা শুনে লোকটি ভীত হয়ে অস্থির হয়ে পড়ল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : – ﻟﻦ ﺗﺮﺍﻉ، ﻟﻦ ﺗﺮﺍﻉ، ﻭﻟﻮ ﺃﺭﺩﺕ ﺫﻟﻚ – ﺃﻱ ﻗﺘﻠﻲ – ﻟﻢ ﺗﺴﻠﻂ ﻋﻠﻲ . ভয় করো না, ভয় করো না, যদিও তুমি আমাকে হত্যা করার ইচ্ছা করেছ কিন্তু তুমি আমাকে হত্যা করতে পারবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা তাঁকে অবহিত করেছেন যে, তিনি তাঁকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ক্ষমা করে দিলেন-অথচ সে তাঁকে হত্যা করার মনস্থ করেছিল। সাহসিকতা সাহসিকতা, নির্ভীকতা, যথা-সময়ে উদ্যোগ গ্রহণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিশেষ গুণ ছিল। তাঁর সাহিসকতা বড় বড় বীরদের নিকট অবিসংবাদিতভাবে স্বীকৃত। আলি ইবনে আবুতালিব (র:) বলতেন :- ﻛﻨﺎ ﺇﺫﺍ ﺣﻤﻲ ﺍﻟﺒﺄﺱ، ﻭﺍﺣﻤﺮﺕ ﺍﻟﺤﺪﻕ ﻣﺎ ﺗﺤﺖ ﺍﻷﺟﻔﺎﻥ ﻣﻦ ﺷﺪﺓ ﺍﻟﻐﻀﺐ ﻧﺘﻘﻲ ﺑﺮﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ যুদ্ধ যখন প্রচণ্ড রূপ নিত, প্রবলভাবে ক্রোধান্বিত হওয়ার ফলে চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করত তখন আমরা (তীর-তরবারির আঘাত থেকে বাঁচার জন্য) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা-কবচ হিসেবে গ্রহণ করতাম। ইমরান ইবনে হাছিন (র:) বলেন :- ﻣﺎ ﻟﻘﻲ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻛﺘﻴﺒﺔ ، ﺇﻻ ﻛﺎﻥ ﺃﻭﻝ ﻣﻦ ﻳﻀﺮﺏ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন বাহিনীর মুখোমুখী হলে প্রথম আঘাতকারী হতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহসিকতার একটি নমুনা নীচে উল্লেখ করা হল। – এক রাত্রে মদিনার এক প্রান্ত কারো চিৎকারের আওয়ায শুনা গেল। কিছু মানুষ আওয়াজের দিকে অগ্রসর হলো, কিন্তু দেখা গেল রাসূলুল্লাহ (সা.) একাই আওয়াজের উৎসস্থলে তাদের আগে গিয়ে পৌঁছলেন- বরঞ্চ তিনি যখন অবস্থা দেখে ফিরছিলেন তখন তাদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হলো। তিনি ছিলেন আবু তালহার অসজ্জিত ঘোড়ার উপরে। তরবারি ছিল তাঁর স্কন্ধে। আবু তালহা বলতে লাগলেন :— ﻛﺎﻥ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﺃﺣﺴﻦ ﺍﻟﻨﺎﺱ ، ﻭﺃﺟﻮﺩ ﺍﻟﻨﺎﺱ، ﻭﺃﺷﺠﻊ ﺍﻟﻨﺎﺱ، ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺒﺨﺎﺭﻯ : 2608 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বাপেক্ষা সুন্দর, সর্বাপেক্ষা দানশীল, সর্বাপেক্ষা সাহসী। ওয়েব গ্রন্থনা : আবুল কালাম আযাদ আনোয়ার / ভাষাগত সম্পাদনা : কাউসার বিন খালেদ /সার্বিক যত্ন : আবহাছ এডুকেশনাল এন্ড রিসার্চ সোসাইটি, বাংলাদেশ।

Post a Comment

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

Previous Post Next Post