ইসলামি আকিদা : পরিচয় ও উৎস-উৎপত্তি এবং গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা


ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস বিষয়ক প্রসিদ্ধতম শব্দ বা পরিভাষা হলো ‘আকিদা’। একজন মুসলিমের প্রকৃত অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত একটি বিষয় এই আকিদা বা বিশ্বাস। হিজরি চতুর্থ শতকের আগে এ শব্দ বা পরিভাষাটির প্রয়োগ এতোটা প্রসিদ্ধ ছিলো না। চতুর্থ হিজরি শতক পর থেকেই মূলত এ পরিভাষাটির প্রচলন-প্রসিদ্ধি ঘটে। [ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রচিত কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা] একজন মুমিন বা পরিশুদ্ধ একজন মুসলিমের পরলৌকিক ও ইহলৌকিক জীবনের সফলতা বা কামিয়াবির সাথে এই শব্দ বা পরিভাষাটির সম্পর্ক খুব গভীর। তাই এ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান অর্জন করার গুরুত্ব অপরীসীম।

 আকিদার শাব্দিক পরিচয় : আকিদা শব্দটি একটি আরবি শব্দ। ‘আক্দুন’ মূলধাতু থেকে গৃহীত বা উৎপন্ন। এর শাব্দিক অর্থ বন্ধন করা, গিরা দেওয়া, চুক্তি করা বা শক্ত হওয়া ইত্যাদি। আরবী ভাষাবিদ ইবনু ফারিস এই শব্দের অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আইন, ক্বাফ ও দাল- ধাতুটির মূল অর্থ একটিই। আর তা হলো- দৃঢ়করণ, দৃঢ়ভাবে বন্ধন, ধারণ বা নির্ভর করা। শব্দটি যত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা সবই এই অর্থ থেকে গৃহীত। [ইবনু আবী শাইবা, আবু বাকর আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ (২৩৫ হি), আল-মুসান্নাফ (রিয়াদ, সৌদি আরব, মাকতাবাতুর রুশদ, ১ম প্রকাশ, ১৪০৯ হি)]

এছাড়া আকিদার শাব্দিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ইসলামি আকিদা বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থে এইভাবে আলোচনা তুলে ধরা হয়েছে…

كلمة “عقيدة” مأخوذة من العقد والربط والشدّ بقوة، ومنه الإحكام والإبرام، والتماسك والمراصة. # بيان عقيدة أهل السنة والجماعة ولزوم اتباعها 1/4

আকিদা শব্দটি আক্দুন মূলধাতু থেকে গৃহীত। যার অর্থ হচ্ছে, সূদৃঢ়করণ, মজবুত করে বাঁধা। [বায়ানু আকিদাতু আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ, ১/৪]

আকিদার পারিভাষিক পরিচয় : আকিদার পারিভাষিক সংজ্ঞা বর্ণনা করতে গিয়ে আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ আল-ফাইউমী (রহ.) তার রচিত আল মিসবাহুল মুনীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, মানুষ ধর্ম হিসেবে যা গ্রহণ করে তাকেই আকিদা বলা হয়।

ইসলামি পরিভাষায় আকিদা বলা হয়- নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা এবং সেই বিশ্বাসের পরিপালন করা। সুতরাং ইসলামি আকিদা বলতে এমন কিছু বিষয়ের ওপর বিশ্বাস করাকে বুঝায় যার কারণে ঐ ব্যক্তিকে মুমিন বিবেচিত করা হয়। [ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রচিত কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা]

এছাড়া ইসলামি আকিদার সংজ্ঞা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে,

العقيدة الإسلامية: هي الإيمان الجازم بالله، وملائكته، وكتبه، ورسله، واليوم الآخر، والقدر خيره وشره، وبكل ما جاء في القرآن الكريم، والسنة الصحيحة من أصول الدين، وأموره، وأخباره. # رسائل الشيخ محمد بن إبراهيم في العقيدة 7/2

শরীয়তের পরিভাষায় ইসলামি আকিদা হচ্ছে, মহান আল্লাহ তাআলা, তাঁর ফেরেশতাকুল, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ, শেস দিবস তথা মৃত্যু পরবর্তী যাবতীয় বিষয় ও তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি এবং আল-কুরআনুল হাকিম ও সহিহ হাদিসে উল্লেখিত দীনের সকল মৌলিক বিষয়ের প্রতি অন্তরের সুদৃঢ় মজবুত ও বিশুদ্ধ বিশ্বাসের নাম আকিদা। [রিসালাতুম শাইখ মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম ফিল আকিদা, ৭/২]

আকিদার শব্দের পারিভাষিক প্রচলন-ইতিহাস : ‘ধর্মবিশ্বাস’ বুঝাতে আকিদা শব্দের ব্যবহার পরবর্তী যুগে ব্যাপক হলেও প্রাচীন আরবী ভাষার এর ব্যবহার খুব বেশি দেখতে পাওয়া যায় না। ‘বিশ্বাস’ বা ‘ধর্মবিশ্বাস’ অর্থে ‘আকিদা’ ও ‘ইতিকাদ’ শব্দের ব্যবহার কোরআন ও হাদিসেও দেখা যায় না। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে বা তাঁর পূর্বের যুগে আরবি ভাষায় ‘বিশ্বাস’ অর্থে বা অন্য কোনো অর্থে ‘আকিদা’ শব্দের ব্যবহার ছিল বলে জানা যায় না। তবে ‘দৃঢ় হওয়া’ বা ‘জমাট হওয়া’ অর্থে ‘ইতিকাদ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

এছাড়া অন্তরের বিশ্বাস অর্থেও ‘ইতিকাদ’ শব্দটির প্রচলন ছিল। প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ইসমাঈল ইবনু হাম্মাদ জাওহারি (৩৯৩ হি) বলেন, “সম্পত্তি বা সম্পদ ‘ইতিকাদ’ করেছে, অর্থাৎ তা অর্জন করেছে বা সঞ্চয় করেছে। কোনো কিছু ‘ইতিকাদ’ হয়েছে অর্থ শক্ত, কঠিন বা জমাটবদ্ধ হয়েছে। অন্তর দিয়ে অমুক বিষয় ইতিকাদ করেছে। তার কোনো মাকুদ নেই অর্থাৎ তার মতামতের স্থিরিতা বা দৃঢ়তা নেই।” [আহমদ ইবনু হাম্বাল (২৪১হি), আল-মুসনাদ, কাইরো, মিশর, মুআসসাসাতু কুরতুবাহ ও দারুল মাআরিফ, ১৯৫]

কোরআন-হাদিসে কোথাও আকিদা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে বলে জানা যায় না। ‘ইতিকাদ’ শব্দটি দু একটি হাদিসে ব্যবহৃত হয়েছে, তবে ‘বিশ্বাস’ অর্থে নয়, বরং সম্পদ, পতাকা ইত্যাদি দ্রব্য দৃঢ়ভাবে ধারণ করা, বন্ধন করা বা গ্রহণ করা অর্থে। দ্বিতীয় শতাব্দীর কোনো কোনো ইমাম ও আলিমের কথায় ‘ইতিকাদ’ বা ‘আকিদা’শব্দ সুদৃঢ় ধর্ম বিশ্বাস অর্থে ব ̈বহৃত হয়েছে বলে দেখা যায়। পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে ‘আকিদা’ শব্দের ব ̈বহার ব্যপকতা লাভ করে। চতুর্থ-পঞ্চম শতকে লিখিত প্রাচীন আরবি অভিধানগুলিতে ‘আকিদা’ শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে বলে দেখতে পাইনি। [ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রচিত কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা]

ইসলামের মৌলিক আকিদা বা ইমানের স্তম্ভসমূহ : ‘মুমিন’ বা ঈমানদার হিসেবে গণ্য হতে একজন মানুষকে কী কী বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে তা মহান আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া রাসূলের (সা.) সুন্নাহ বা হাদিসেও বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ইসলামের পরিভাষায় এগুলিকে ‘আরকানুল ঈমান’ বা ঈমানের স্তম্ভ বলা হয়।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোর মধ্যে কোনো পুণ্য নেই। কিন্তু পুণ্য তার যে বিশ্বাস স্থাপন করেছে আল্লাহর প্রতি, পরকালের প্রতি, ফেরেশতাগণের প্রতি, কিতাবসমূহে ও নবীগণের প্রতি এবং ধন-সম্পদের প্রতি মনের টান থাকা সত্ত্বেও আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন-অনাথ, অভাবগ্রস্ত, পথিক, সাহায্য প্রার্থনাকারীগণকে ও দাসমুক্তির জন্য অর্থ ব্যয় করে, এবং সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, প্রতিশ্রুতি দিলে তা পূর্ণ করে আর অর্থ-সংকটে, দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রাম-সংকটে ধৈর্য্য ধারণ করে। এরাই প্রকৃত সত্যপরায়ণ এবং এরাই মুত্তাকী।’ [সূরাহ বাকারা: ১৭৭]

এখানে আল্লাহ তাআলা জানিয়েছেন যে, শুধু আনুষ্ঠানিকতার নাম ইসলাম নয়, প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতায় কোনো পুণ্য নেই। ইসলাম হলো বিশ্বাস ও কর্মের সমন্বয়। এখানে আল্লাহ মুমিনের বিশ্বাসের মৌলিক পাঁচটি বিষয় এবং তার মৌলিক কর্ম ও চরিত্রের বর্ণনা দিয়েছেন।

অন্যত্র আল্লাহ মহান বলেন, ‘রাসূল তাঁর প্রতি তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতে ঈমান এনেছেন এবং মুমিনগণও। তারা সকলেই আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহে এবং তাঁর রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য করি না।’ [সূরাহ বাকারা: ২৮৫]

এখানে ঈমানের স্তম্ভগুলির মধ্য থেকে ৪টি বিষয় উল্লে­খ করা হয়েছে। অন্য আয়াতে ৫টি বিষয়ের উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর ওপর, তাঁর রাসূলের ওপর আর যে গ্রন্থ তাঁর রাসূলের প্রতি অবতীর্ণ করেছেন তার ওপর এবং যেসব গ্রন্থ তিনি পূর্বে অবতীর্ণ করেছেন তাতে বিশ্বাস স্থাপন করো। অতঃপর কেউ আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর গ্রন্থসমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং আখিরাতকে অবিশ্বাস করলে সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়বে।’ [সূরাহ নিসা: ১৩৬]

এভাবে কুরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে উপরের বিষয়গুলি একত্রে বা পৃথকভাবে উল্লে­খ করা হয়েছে। বিভিন্ন হাদীসেও ঈমানের রুকন বা স্তম্ভগুলি উল্লে­খ করা হয়েছে। ঈমানের পরিচয় দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘(ঈমান এই যে,) তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহয়, তাঁর ফেরেশতাগণে, তাঁর কিতাবসমূহে, তাঁর সাক্ষাতে, তাঁর রাসূলগণে; তুমি বিশ্বাস করবে শেষ পুনরুত্থানে এবং তুমি বিশ্বাস করবে তাকদীর বা নির্ধারিত বিষয়সমূহে।’ [সহীহুল বুখারী: ১/২৭, ৪/১৭৩৩; সহীহ মুসলিম: ১/৩৯, ৪০, ৪৭]

হজরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) অন্য এক হাদীসে। তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট বসে ছিলাম। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি সেখানে আসলেন। তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ অত্যন্ত ধবধবে সাদা এবং মাথার চুলগুলো অত্যন্ত পরিপাটি ও কাল।..তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে ঈমান সম্পর্কে প্রশ্ন করে বলেন, ঈমান কী তা আমাকে বলুন। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ঈমান হলো এই যে, তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর গ্রন্থসমূহে, তাঁর রাসূলগণে ও শেষ দিবসে (আখিরাতে) এবং বিশ্বাস করবে আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীরের (ভাগ্যের) ভাল ও মন্দে।’ [সহীহ মুসলিম: ১/৩৫-৩৬]

এভাবে বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, ইসলামের মৌল বিশ্বাস বা ‘আল-আকীদাহ আল ইসলামিয়্যাহ’-র সাতটি মৌলিক স্তম্ভ রয়েছে—

১. আল্লাহর ওপর ঈমান। ২. আল্লাহর ফেরেশতাগণের প্রতি ঈমান। ৩. আল্লাহর নাযিল করা কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান। ৪. আল্লাহর রাসূলগণের ওপর ঈমান। ৫. পুনরুত্থানের প্রতি ইমান। ৬. কিয়ামত, পরকাল বা আখিরাতের ওপর ঈমান এবং৭. তাকদীর বা আল্লাহর নির্ধারণ ও সিদ্ধান্তের ওপর ঈমান। এ বিষয়গুলোকে আরকানুল ঈমান, অর্থাৎ ঈমানের স্তম্ভসমূহ, ভিত্তিসমূহ বা মূলনীতিসমূহ বলা হয়।

আকিদার গুরুত্ব : আকিদার গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে এর গুরুত্ব বহনকারী কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো-

১. এক আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসীগণ প্রশান্তচিত্তের অধিকারী, বিপদে-আপদে, তারা শুধু তাঁকেই আহ্বান করে, পক্ষান্তরে বহু-ঈশ্বরবাদীরা বিপদক্ষণে কাকে ডাকবে, এ সিদ্ধান্ত নিতেই কিংকর্তব্য বিমুঢ়।

২. মহান আল্লাহ সর্বোজ্ঞ, সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা সুতরাং তিনি সব জানেন, সব দেখেন এবং সব শোনেন। কোনো কিছুই তাঁর নিকট গোপন নয়-এমন বিশ্বাস যিনি করবেন, তিনি আল্লাহর ইচ্ছায় প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল পাপ হতে মুক্ত থাকতে পারবেন।

৩. নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা জ্ঞান, শ্রবণ, দর্শন ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের অতি নিকটবর্তী। তিনি দোআকারীর দোআ কবুল করেন, বিপদগ্রস্তকে বিপদমুক্ত করেন। বিশুদ্ধ ‘আকিদা বিশ্বাস লালনকারীগণ এটি মনেপ্রাণে গ্রহণ করে সর্বাবস্থায় তাঁর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করে। পক্ষান্তরে একাধিক মাবুদে বিশ্বাসীগণ দোদুল্যমান অবস্থায় অস্থির-অশান্ত মনে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করে। সুতরাং একজন মুমিন মুসলামানের জন্য আকিদা বা বিশ্বাসকে গুরুত্ব প্রদান করা অবশ্যক।

আকিদার উৎস : ইসলামি বিশ্বাস বা ‘আল-আকিদাহ আল-ইসলামিয়্যাহ’-এর ভিত্তিগত উৎস কোরআন ও হাদিসের জ্ঞান। পবিত্র কোরআনে ও সহিহ হাদিসে যা বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে তাই বিশ্বাস করা এবং যেভাবে বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে সেভাবেই বিশ্বাস করা ইসলামি আকিদার মূল ভিত্তি। এছাড়া বিশ্বাস বনাম জ্ঞানবিশ্বাস বা ঈমানের ভিত্তি হলো জ্ঞান। কোনো বিষয়ে বিশ্বাস করতে হলে তাকে জানতে হবে। বিশুদ্ধ ঈমান বা বিশ্বাসই যেহেতু দুনিয়া ও আখিরাতে মানবীয়  সফলতার  মূল চাবিকাঠি  সেহেতু  ঈমান বিষয়ক  জ্ঞান  অর্জন করাই  মানব  জীবনের সর্বপ্রথম ও  সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফরজ দায়িত্ব। মহান আল্লাহ বলেন, অতএব তুমি জেনে রাখ যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ বা উপাস্য নেই। [ইবনু আবি আসিম, আবূ বাকর আমর (২৮৭ হি), কিতাবুস সুন্নাহ (বৈরুত, আল-মাকতাব আল-ইসলামী, ৩য় মুদ্রণ, ১৯৯৩] সুতরাং বিশুদ্ধ ঈমান বিষয়ক সঠিক জ্ঞানই মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান।

আকিদার মূল ভিত্তি : ইসলামি আকিদার মূল ভিত্তি হলো, আল্লাহ, ফিরিশতাগণ, আসমাসি কিতাবসমূহ, আল্লাহর প্রেরিত নবি-রাসূলগণ, আখিরাত দিবস এবং তাকদিরের ভালো কিংবা মন্দের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা। এ মর্মে আল্লাহ মহান ইরশাদ করেন, বরং ভালো কাজ হলো, যে ঈমান আনে আল্লাহ, শেষ দিবস, ফিরিশতাগণ, কিতাব ও নবিগণের প্রতি। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭৭]

তিনি আরো ইরশাদ করেন, রাসূল তার নিকট তার রবের পক্ষ থেকে নাজিলকৃত বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছে, আর মুমিনগণও। প্রত্যেকে ঈমান এনেছে আল্লাহর উপর, তাঁর ফিরিশতাকুল, কিতাবসমূহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি, আমরা তাঁর রাসূলগণের কারও মধ্যে তারতম্য করি না। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৮৫]

আরো ইরশাদ হেয়েছে, আর যে কেউ আল্লাহ, তাঁর ফিরিশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং শেষ দিনকে অস্বীকার করবে, সে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত হবে। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৩৬]

হজরত জিবরাইলল আলাইহিস সালাম ঈমান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে রাসূলুল্লাহ (সা.) উত্তরে বলেন, ঈমান হলো, আল্লাহর উপর ঈমান স্থাপন করা, আল্লাহর ফিরিশতা, আসমানি কিতাবসমূহ, আল্লাহর প্রেরিত নবি-রাসূলগণ, আখিরাত দিবস এবং তাকদিরের ভালো কিংবা মন্দের উপর ঈমান আনয়ন করা। [সহিহ মুসলিম ২/৮]

ঈমান ও আকিদার মধ্যে পার্থক্য : ‘আকিদা’ শব্দটি প্রায়ই ঈমান ও তাওহিদের সঙ্গে গুলিয়ে যায়। মূলত অস্বচ্ছ ধারণার ফলে এমনটা হয়। প্রথমত, ঈমান সমগ্র দ্বীনকেই অন্তর্ভুক্ত করে। আর আকিদা দীনের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। দ্বিতীয়ত, আকিদার তুলনায় ঈমান আরও ব্যাপক পরিভাষা। আকিদা হলো কিছু ভিত্তিমূলক বিষয়ের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের নাম।  অন্যদিকে ঈমান শুধু বিশ্বাসের নাম নয়; বরং মৌখিক স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের মাধ্যমে তার বাস্তব প্রতিফলনকে অপরিহার্য করে দেয়। সুতরাং ঈমানের দুটি অংশ। একটি হলো অন্তরে স্বচ্ছ আকিদা পোষণ। আরেকটি বিষয় হলো বাহ্যিক তৎপরতায় তার প্রকাশ। এ দুটি পরস্পরের সঙ্গে এমনভাবে সংযুক্ত যে কোনো একটির অনুপস্থিতি ঈমানকে বিনষ্ট করে দেয়। তৃতীয়ত, আকিদা হলো ঈমানের মূলভিত্তি। আকিদা ব্যতীত ঈমানের উপস্থিতি তেমন অসম্ভব, যেমনিভাবে ভিত্তি ব্যতীত কাঠামো কল্পনা করা অসম্ভব।

একনজরে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ কিছু আকিদা-বিশ্বাস : ১. আল্লাহ একক, তাঁর কোনো শরিক নেই। (আকিদাতুত্ ত্বাহাভি)। ২. আল্লাহর সত্তাও অনাদি, তাঁর গুণাবলিও অনাদি। (প্রাগুক্ত)। ৩. আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত সব কিছু অনিত্য, পরবর্তী সৃষ্ট। (শরহে আকায়েদ নাসাফিয়া)। ৪. বিবেক, শক্তি ও চক্ষুদ্বয় আল্লাহ তায়ালার সত্তাকে আয়ত্ত করতে পারে না। (আকিদাতুত্ ত্বাহাভি)। ৫. আল্লাহ তায়ালা কারো মুখাপেক্ষী নন। সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী। (প্রাগুক্ত)। ৬. আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই। (প্রাগুক্ত)। ৭. আল্লাহ তায়ালা চিরঞ্জীব। তাঁর মৃত্যু নেই। (প্রাগুক্ত)। ৮. আল্লাহ তায়ালার সমকক্ষ কেউ নেই। (প্রাগুক্ত)। ৯. কোনো বস্তুতে আল্লাহ তায়ালার সাদৃশ্য নেই। (প্রাগুক্ত)। ১০. আল্লাহ তায়ালা দৃশ্য-অদৃশ্য সব বিষয়ে জ্ঞাত। (প্রাগুক্ত)। ১১. আল্লাহ তায়ালা সর্বদ্রষ্টা। কোনো কিছুই তাঁর দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য নয়। (প্রাগুক্ত)। ১২. আল্লাহ তায়ালা নিচু ও উচ্চ- সব শব্দ শ্রবণ করে থাকেন। (প্রাগুক্ত)। ১৩. আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ব্যতীত কোনো কিছুই হতে পারে না। (প্রাগুক্ত)। ১৪. আল্লাহ তায়ালা সর্বশক্তিমান। কোনো কিছুই তাঁর শক্তির বহির্ভূত নয়। (প্রাগুক্ত)। ১৫. আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কেউ অদৃশ্যের জ্ঞান রাখেন না, এমনকি নবীগণও নন, অলিগণও নন। (শরহে আক্বাইদ)। ১৬. আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কেউ হাজির নাজির (সর্বত্র উপস্থিত ও দর্শক) নন। এমনকি নবীগণও নন অলিগণও নন। (বাদাইউল কালাম ফি আক্বাঈদিল ইসলাম)। ১৭. আল্লাহ তায়ালার কোনো সন্তান নেই, স্ত্রীও নেই। (সুরায়ে জ্বিন, আয়াত : ৩)। ১৮. আল্লাহ তায়ালা সব কিছুর স্রষ্টা। (আকিদাতুত্ ত্বাহাভি)। ১৯. আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি বস্তুর (প্রাণীর) পরিমাণমতো রুজিদাতা। (প্রাগুক্ত)। ২০. আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ ব্যতীত না জীবন হতে পারে, না মৃত্যু। (প্রাগুক্ত)। ২১. আল্লাহ তায়ালাই সব রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারেন। তিনিই সব প্রয়োজন পূরণকারী। (প্রাগুক্ত)। ২২. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সিজদা করা, কারো নামে মানত করা কুফরি। (সুরা হা-মীম সিজদা, আয়াত : ৩৫, সুরা মা-ইদাহ, আয়াত : ৩)। ২৩. মৃতদের থেকে সাহায্য প্রার্থনা করা শিরক। (বাদাইউল কালাম)। ২৪. ভালো-মন্দ সব কিছুর সিদ্ধান্ত আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে হয়। (আকিদাতুত্ ত্বাহাভি)। ২৫. সব নবী ও রাসুলের প্রতি ইমান রাখা। (শরহে আক্বাইদ)। ২৬. সব নবীগণকে নিষ্পাপ মনে করা। (প্রাগুক্ত)। ২৭. নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহ তায়ালার বান্দা ও রাসুল। (আকিদাতুত্ ত্বাহাভি)। ২৮. আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কিয়ামত পর্যন্ত সব মানুষ ও জ্বিনের প্রতি প্রেরিত। (প্রাগুক্ত)। ২৯. তিনি সব রাসুলের সর্দার ও সর্বশেষ নবী। (প্রাগুক্ত)। ৩০. নবী করিম (সা.)-এর জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে মিরাজে গমন করা সত্য। (শরহে আক্বাইদ)। ৩১. তাঁর পর কোনো নবীই নেই, না মূল নবী, না ছায়া নবী। (বাদাইউল কালাম)। ৩২. তাঁর পরে নবুওয়তের দাবিদার ও তাদের অনুসারীরা সবাই কাফের। (প্রাগুক্ত)। ৩৩. হজরত ঈসা (আ.)-এর জীবিত থাকা এবং তাঁকে আকাশে উঠিয়ে নেওয়া সত্য। (সুরা নিসা, আয়াত : ১৫৮)। ৩৪. হজরত ঈসা (আ.) আমাদের রাসুল (সা.)-এর শরিয়তের অনুসারী হয়ে কিয়ামতের আগে আকাশ থেকে অবতরণ করবেন। (শরহে আক্বাইদ)। ৩৫. হজরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে আল্লাহর ছেলে হওয়ার ও তিন খোদার এক খোদা হওয়ার বিশ্বাসী ব্যক্তি কাফের। (সুরা মা-ইদাহ, আয়াত : ৭৩, সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৪৯)। ৩৬. কোরআন ও হাদিস শরিফকে অস্বীকার করা, নবী করিম (সা.)-এর প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা, শরিয়তকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা কুফরি। (বাদাইউল কালাম, শরহে আক্বাইদ)। ৩৭. নবীগণের মুজিযা সত্য। (শরহে আক্বাইদ)। ৩৮. নবীগণ নিজ নিজ কবরে জীবিত। (মুসনাদে আবি ইয়ালা)। ৩৯. সাহাবায়ে কেরাম উম্মতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। (শরহে আক্বাইদ)। ৪০. সব সাহাবায়ে কিরাম সমালোচনার ঊর্ধ্বে। (প্রাগুক্ত)। ৪১. সাহাবায়ে কিরাম আল্লাহ তায়ালার পছন্দনীয় বান্দা, তাঁরা দুনিয়ায়ই জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত। (সুরা তাওবা, আয়াত : ১০০)। ৪২. সাহাবায়ে কিরামের মুহাব্বত ইমানের অংশ। (আকিদাতুত্ ত্বাহাভি)। ৪৩. সাহাবায়ে কিরামের সঙ্গে দুশমনি রাখা, তাঁদের সমালোচনা করা মুনাফেকি। (প্রাগুক্ত)। ৪৪. খোলাফায়ে রাশেদিনের মর্যাদা তাঁদের খিলাফতের ক্রমবিন্যাস মতে। (প্রাগুক্ত)। ৪৫. সাহাবায়ে কিরাম পরস্পরের যুদ্ধ ও মতবিরোধে সবাই সত্যের ওপর ছিলেন। (প্রাগুক্ত)। ৪৬. অলিগণ আল্লাহ তায়ালার নিকটতম বান্দা। (সুরা ইউনুস, আয়াত : ৬২)। ৪৭. তাঁরা মর্যাদায় নবীগণ ও সাহাবায়ে কিরাম থেকে নিচুস্তরের। (বাদাইউল কালাম)। ৪৮. অলিগণের কারামত সত্য। (আকিদাতুত্ ত্বাহাভি)। ৪৯. পূর্বপুরুষদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং চার ইমামের তাকলিদ করা অত্যন্ত জরুরি। (প্রাগুক্ত)। ৫০. আল্লাহ তায়ালার সব ফিরিশতার ওপর ইমান রাখা। (প্রাগুক্ত)। ৫১. আল্লাহ তায়ালার নাজিলকৃত সব কিতাবের ওপর ইমান রাখা। (প্রাগুক্ত)। ৫২. ইমান রাখা যে কোরআনে কারিম আল্লাহ তায়ালার কালাম বা বাণী। (প্রাগুক্ত)। ৫৩. কোরআন শরিফ নাজিল হওয়ার পর আগের সব আসমানি কিতাব রহিত হয়ে গেছে। (শরহে আক্বাইদ)। ৫৪. শেষ জামানায় ইমাম মাহদী (আ.)-এর খেলাফত সত্য। (মিশকাত শরিফ)। ৫৫. দাজ্জাল ও ইয়াজুজ-মাজুজের বের হওয়া সত্য। (আকিদাতুত্ ত্বাহাভি)। ৫৬. পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া এবং বিশেষ ধরনের প্রাণীর আবির্ভাব হওয়া সত্য। (প্রাগুক্ত)। ৫৭. কিয়ামতের অন্যান্য নিদর্শন এবং শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া সত্য। (সহিহ বুখারি)। ৫৮. কবরে মুনকার-নাকিরের প্রশ্ন এবং কবরের আজাব সত্য। (আকিদাতুত ত্বাহাভি)। ৫৯. মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বার জীবিত হওয়া এবং হাশরে উপস্থিত হওয়া সত্য। (প্রাগুক্ত)। ৬০. হাউজে কাউসার এবং সুপারিশ সত্য। (প্রাগুক্ত)। ৬১. আমলগুলোর ওজন এবং কিতাব বা আমলনামা প্রদান সত্য। (প্রাগুক্ত)। ৬২. পুলসিরাত, জান্নাত ও দোজখ সত্য। (প্রাগুক্ত)। ৬৩. আখিরাতে আল্লাহ তায়ালার দিদার বা সাক্ষাৎ সত্য। (প্রাগুক্ত)। ৬৪. পরকালে মুমিনদের সর্বদা জান্নাতে এবং কাফেরদের সর্বদা জাহান্নামে থাকা সত্য। (প্রাগুক্ত)। ৬৫. ফাসেককে কাফের বলা যাবে না, সে জাহান্নামে সর্বদা থাকবে না। (প্রাগুক্ত)। ৬৬. আল্লাহ তায়ালার আরশ ও সিংহাসন সবচেয়ে বড় সৃষ্টি। (প্রাগুক্ত)। ৬৭. লাওহে মাহফুজ, কলম ও রূহের জগতের অঙ্গীকার সত্য। (প্রাগুক্ত)। ৬৮. ইসলামই আল্লাহ তায়ালার কাছে একমাত্র পছন্দনীয় ধর্ম। (প্রাগুক্ত)। ৬৯. ইসলাম ব্যতীত জাহান্নাম থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই। (প্রাগুক্ত)। ৭০. শরিয়তের বিধান চালু করার জন্য আমির নিযুক্ত করা অপরিহার্য। (শরহে আক্বাইদ)। 

Post a Comment

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

Previous Post Next Post