নেশা ও সমাজ : ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

বর্তমানে সর্বত্র নেশার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে। তবে পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সমাজগুলোর আচরণ হাস্যকর। তারা হয়তো কোনো এক সমাবেশে নেশার বিরুদ্ধে কথা বলছে, আর সে সমাবেশেই পরিবেশন করা হচ্ছে মদ। এটাই হলো আজকের বিশ্ব সংস্কৃতি। ইসলামী জীবনাদর্শ এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। খাবার ও পানীয়ের ব্যাপারে মূলনীতি হলো এই, মানুষের জন্য যা ক্ষতিকর তা নিষিদ্ধ। যেসব খাবার বা পানীয় কঠিনভাবে নিষিদ্ধ তাদের অন্তর্ভুক্ত হলো নেশাজাতীয় সব পণ্য ও শূকরের মাংস। এই নিষেধাজ্ঞা কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত আছে। সূরা মায়েদায় বলা হয়েছে ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, বেদী এবং ভাগ্য নির্ণায়ক তীর হলো অপবিত্র শয়তানি কাজ। সুতরাং তোমরা তা থেকে বেঁচে থাকো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো। শয়তান তো চায়, মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে তোমাদের ফিরিয়ে রাখতে। অতএব তোমরা কি (এসব থেকে) বিরত থাকবে’ (মায়েদাহ : ৯০-৯১)? এখানে পরিষ্কারভাবে নেশা ও মদের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণাটি কতটুকু গুরুত্বের সাথে দেয়া হয়েছে সেদিকে একটু খেয়াল করা যাক। প্রথম আয়াতটিতে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার প্রথমে ইন্নামা আরবি শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যার অর্থ হলো নিঃসন্দেহে ও নিশ্চিতভাবে। অর্থাৎ নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে যা বলা হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে ও নিশ্চতভাবে সত্য। দ্বিতীয়, মানুষের অন্যান্য অপরাধের বেলায় তা স্বাভাবিক ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু নেশা ও মদের নিষেধাজ্ঞার বেলায় বলা হয়েছে, এটা হলো অপবিত্র, শয়তানি কাজ। অর্থাৎ নেশা ও মদ গ্রহণ মানুষের কাজ নয়। শয়তানের কাজ। তৃতীয়, মানুষকে এ থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যাতে সফল হতে পারে। অর্থাৎ দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্য এবং বিশেষ করে আখিরাতের মুক্তি পাওয়ার শর্ত হলো নেশা ত্যাগ করা। চতুর্থ, বলা হয়েছে মদ ও জুয়া মানুষের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে। এ জন্যই দেখা যায়, পশ্চিমা জগতগুলোর নাইট ক্লাবে দ্বন্দ্ব, সঙ্ঘাত, আক্রমণ, মারামারি ও হত্যা লেগেই থাকে। শুধু পশ্চিমা জগতেই নয়। বাংলাদেশেও নেশাগ্রস্তদের সহিংস আচরণ ঐশীর ঘটনা থেকে পাওয়া যায়। পঞ্চম, বলা হয়েছে, নেশা ও মদ মানুষকে আল্লাহর ইবাদত থেকে ফিরিয়ে রাখে। মদ ও নেশাগ্রস্তদের বিবেক ও মনমানসিকতা নেশার আবর্তে আচ্ছন্ন থাকে এবং তারা সুস্থ মনে সত্যপথের চিন্তা করতে পারে না। আল্লাহর স্মরণ, নামাজ ও অন্যান্য ইবাদত কঠিন হয়ে পড়ে। ষষ্ঠ, নেশা ও অন্যান্য নিষিদ্ধ জিনিসগুলোর কথা বলার পর এখানে আল্লাহ হুমকিস্বরূপ প্রশ্ন করেছেন : হে মানুষ! তোমরা কি এ থেকে বিরত থাকবে? সার কথা, অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে যেভাবে নিষেধাজ্ঞা এসেছে, তার চেয়ে অত্যন্ত কঠিনভাবে মদ ও নেশার নিষেধাজ্ঞা এসেছে। নেশা ও মদের বিরুদ্ধে করুণাময় আল্লাহর এই শক্ত অবস্থান তাঁর রাসূল মুহাম্মদ সা:-এর আদর্শেও প্রতিফলিতহ হয়েছে। তাঁর তিনটি বাণী এখানে উদ্ধৃত করা হচ্ছে। ‘কেউ যদি মদ পান করে সে সময় তার ঈমান থাকে না (তার ভিতর থেকে ঈমান বেরিয়ে উপরে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে)’ [বুখারি ও মুসলিম]। ‘রাসূল সা: মদের ওপর এবং যে তা পান করে, যে তা বেচাকেনা করে, যার জন্য তৈরি করা হয়, যে তা বহন করে এবং যার জন্য তা বহন করে তাদের সবার ওপর লানত করেছেন’ (আবু দাউদ)। ‘আমার উম্মতের কেউ যদি কখনো মদ পান করে তারপর থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত তার কোনো ইবাদত কবুল হবে না’ [নাসাঈ]। এই তিনটি বাণী থেকেই বোঝা যায়, রাসূল সা: নেশা ও মদের ব্যাপারে কত কঠিন অবস্থান নিয়েছেন। মুসলিম শরিফের এক হাদিসে আছে, একবার এক ব্যক্তি মদ পান করেছিল; রাসূল সা: তাকে ৪০টি বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দেন। অন্য এক হাদিসে আছে, এই ঘটনায় কেউ কেউ উন্মুক্ত সমাবেশে তাকে বেত্রাঘাত করছিল। তাকে কেউ জুতো দিয়ে আঘাত করছিল। খোলাফায়ে রাশেদীনও মদ পানের শাস্তি হিসেবে এই ব্যবস্থা চালু রাখেন। তবে হজরত উমর রা: ৪০টি বেত্রাঘাতের স্থলে সবার সাথে পরামর্শ করে ৮০টি বেত্রাঘাতের শাস্তি চালু করেন। কেউ কেউ বলেন, ন্যূনপক্ষে ৪০টি বেত্রাঘাত করতে হবে। তবে শাসক যদি চান তাহলে তার শাস্তি আরো বাড়াতে পারেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, যেসব খাবার ও পানীয় গ্রহণ করলে মানুষের ক্ষতি হয় ইসলামী জীবনাদর্শে সেগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন, নেশা ও মদে মানুষের জন্য কী ক্ষতি রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় নেশা ও মদের যেসব ক্ষতি প্রমাণিত হয়েছে তা সংক্ষেপে এখানে বলা হলো : ১. নেশা ও মদ গ্রহণ করতে থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পাকস্থলি ক্রমেই দুর্বল ও তার কার্যক্ষমতা দুর্বল হতে তাকে। ২. চেহারার লাবণ্য নষ্ট হয়। ৩. বার্ধক্য ত্বরান্বিত হয়। ৪. চিন্তাশক্তি আচ্ছন্ন হয় এবং বাকশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৫. নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির সন্তান দুর্বল হয় এবং বিকলাঙ্গ বা প্রতিবন্ধী হতে পারে। ৬. মদ ও নেশায় নানা ধরনের রোগ হয়। বিশেষ করে ক্যানসার ও হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। এগুলো হলো মদ ও নেশার দৈহিক শারীরিক ক্ষতি। নেশা ও মদের আর্থ-সামাজিক ক্ষতিও অনেক। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান কয়েকটির উল্লেখ করছি : ১. বিরাট অপচয় হয়। যেসব ভালো জিনিস দিয়ে মদ তৈরি করা হয় তা মানুষের বিভিন্ন ধরনের বিকল্প কাজে লাগতে পারত। নেশা ও মদ তৈরি করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। আর যারা নেশা করে তারাও প্রচুর অর্থ ব্যয় করে এই নেশার পেছনে। এ সব কারণে জাতীয় আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২. নেশা ও মদের ছড়াছড়িতে অশ্লীলতা ও যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা বৃদ্ধি পায়। এ কারণে স্বামী স্ত্রীতে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। পরিবার ভেঙে যায়। তাদের সন্তান প্রতিপালনে বিশেষ অসুবিধা সৃষ্টি হয়। ৩. গবেষণায় দেখা গেছে, সম্পদ ও নেশায় গভীর সম্পর্ক আছে। আর নেশা ও নারীঘটিত কেলেঙ্কারির মধ্যে গভীর সম্পর্ক আছে। এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে সম্পর্ককে তিনটি ডাব্লিউ বলে প্রকাশ করা হয়। এগুলো হলো সম্পদ, নেশা ও মদ এবং নারী কেলেঙ্কারি। ৪. নেশা সমাজে দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘাত ছড়ায়। পরিবার থেকে সমাজের সর্বত্র এই নেশাজনিত ভায়োলেন্স দেখা যায়। ৫. নেশা নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। মানুষের মধ্যে দুটি সাংঘর্ষিক শক্তি আছে- প্রবৃত্তি ও বিবেক। মদ ও নেশা প্রবৃত্তিকে উজ্জীবিত করে এবং বিবেককে দুর্বল করে দেয়। ফলে নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেয়। যেসব দেশে মদ ও নেশার ছড়াছড়ি আছে তেমন একটি দেশের গবেষণায় নেশা ও মদের কুফল স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমি এখানে অস্ট্রেলিয়ার একটি গবেষণার কিছু পরিসংখ্যান দিচ্ছি। প্রতি বছর সেখানে দুই কোটি মানুষের মধ্যে তিন হাজার অতিরিক্ত মদ পানে মারা যায়। বছরে ৬৫ হাজার লোক অতিরিক্ত মদ পানজনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়। মদের কারণে বছরে দুই হাজার ৫০০ ব্যক্তির মস্তিষ্ক ক্ষরণ হয়। দেশের জঘন্য অপরাধীর ৪৭ শতাংশ নেশাগ্রস্ত। যারা এরূপ জঘন্য অপরাধের শিকার হন, তাদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ হলো নেশাগ্রস্ত। দেশে আগুনজনিত জখম বা আঘাতে আহত মানুষের ৪৪ শতাংশ নেশাগ্রস্ত। যারা এরূপ জঘন্য অপরাধের শিকার হয় তাদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ হলো নেশাগ্রস্ত। দেশে আগুনজনিত জখম বা আঘাতে আহত মানুষের ৪৪ শতাংশ হলো নেশাগ্রস্ত। যারা কোনো উঁচু স্থান থেকে পড়ে অথবা পানিতে ডুবে মারা যায় তাদের ৩৪ শতাংশ হলো নেশাগ্রস্ত। সড়কে ৩০ শতাংশ গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটে নেশাজনিত কারণে। দেশের ১৬ শতাংশ শিশু অপরাধ হয় নেশাগত কারণে। দেশে কলকারখানায় যত দুর্ঘটনা হয় তাদের ৭ শতাংশ হলো নেশাগত কারণে। আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, যুক্তরাজ্যে ক্যানসারে যত লোক মারা যায় তার ৬ শতাংশ হলো নেশাগত কারণে। এই পরিসংখ্যান থেকে মদ ও নেশার এক অত্যন্ত করুণ চিত্র ভেসে উঠেছে। বাংলাদেশে গোপনে ইয়াবাসহ নানা ধরনের নেশার প্রচলন দেদার বিস্তার লাভ করছে। আনন্দের বিষয়, সরকার নেশা ও মদের বিরুদ্ধে ভালো অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সর্বত্র রয়েছে অগণিত গডফাদার। তাদের চেলারা অক্টোপাসের মতো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। বিশেষ করে তারা নতুন প্রজন্মকে নিজেদের শিকার বানিয়ে নিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, কোনো কোনো অনুমোদিত কোমল পানীয়ের মধ্যেও নেশার মিশ্রণ রয়েছে। এগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। ইয়াবাসহ যত প্রকার নেশাজনিত পণ্য আছে তা সমাজ থেকে নির্মূল করা উচিত। আর তা করা উচিত আমাদের জাতির স্বার্থে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে।

Post a Comment

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

Previous Post Next Post