জামিনের ক্ষেত্রে আইনের চর্চা নেই

আশরাফ-উল-আলম
প্রকাশঃ১৩/০৮/২০২১
জামিন অর্থ আইনগত হেফাজত থেকে কোন ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া। আইনের হেফাজত থেকে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া আইন দ্বারা নির্ধারিত রয়েছে বাংলাদেশে প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধিতে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই আইনের চর্চাটা নেই ৷

বাংলাদেশে প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধিতে আদালতের গঠন, আদালতের শ্রেণীকরণ, আদালতের ক্ষমতা, বিচার পদ্ধতি, ফৌজদারি অপরাধের ঘটনার তদন্ত, অপরাধীদের গ্রেফতার, গ্রেফতারকৃতদের জামিন ইত্যাদি বিষয় বাতলে দিয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪ ধারায় আইনের বিভিন্ন সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এই ধারার খ উপধারায় জামিনযোগ্য অপরাধের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, জামিন হচ্ছে আইনগত হেফাজত হতে কোন ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া। আর জামিনযোগ্য অপরাধ এমন একটি অপরাধ যেখানে অধিকার বলে জামিন দাবি করা যায়। জামিনযোগ্য অপরাধে কোন অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিননামা দিতে প্রস্তুত থাকা মাত্র যে পুলিশ কর্মকর্তা বা আদালতের কাছে তিনি জামিন দেওয়ার প্রস্তাব করেন ওই কর্মকর্তা বা আদালত জামিন সম্পর্কে যেমন যুক্তিসংগত প্রতীয়মান হয় তেমন শর্তে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য থাকেন।

গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে জামিন দেওয়া যাবে না এমন বিধান ফৌজদারি কার্যবিধিতে নেই। তবে অপরাধ বিবেচনায় জামিনযোগ্য ও জামিন অযোগ্য অপরাধ ভাগ করা হয়েছে। জামিন অযোগ্য ধারার মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির জামিনের বিধান ফৌজদারি কার্যবিধিতে বলে দেওয়া হয়েছে।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৬ ও ৪৯৭ ধারায় জামিন বিষয়ে বলা হয়েছে। ৪৯৬ ধারায় কোন কোন ক্ষেত্রে জামিন মঞ্জুর করা যাবে তা উল্লেখ করা হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, জামিনের অযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তি কোন থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার কর্তৃক বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার হলে বা আটক থাকলে বা আদালতে হাজির হলে বা তাকে হাজির করা হলে, সে যদি উক্ত অফিসারের হেফাজতে থাকার সময় বা উক্ত আদালতের কার্যক্রম এর কোন পর্যায় জামিন নিতে প্রস্তুত থাকে তাহলে তাকে জামিনে মুক্তি দিতে হবে। অর্থাৎ জামিন অযোগ্য ধারায় অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন পাবেন এটা আইন দ্বারা নির্ধারিত।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারায় জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে যখন জামিন মঞ্জুর করা যাবে সে সম্পর্কে বলা হয়েছে।

এই ধারার (১) উপধারায় বলা হয়েছে, মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোন অপরাধে অপরাধী বলে বিশ্বাস করার মতো যুক্তিসংগত কারণ থাকলে তাকে মুক্তি দেওয়া যাবে না। এই উপধারার প্রথম অংশে বলা হয়েছে, অন্যান্য ক্ষেত্রে জামিন দেওয়া যেতে পারে।

তবে এই ধারায় আরো বলা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধ কোন অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি ১৬ বছরের নিম্ন বয়স্ক হয়, স্ত্রীলোক হয় বা অসুস্থ বা অক্ষম হয় তাহলে আদালত তাকে জামিনে মুক্তি দিতে পারবেন। ৪৯৭ এর (২) ধারায় বলা হয়েছে, তদন্ত অনুসন্ধান বা বিচারের কোনো পর্যায় আদালতের নিকট বা পুলিশ কর্মকর্তার নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, জামিন অযোগ্য ধারায় অপরাধ করেছে বলে বিশ্বাস করার মত যুক্তিসংগত কারণ নেই তাহলে তাকে জামিন দেওয়া যাবে। এক্ষেত্রে আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

জামিনের বিষয়ে আদালতের বিবেচনা মূলক ক্ষমতা সম্পর্কে ৪৯৭ ধারার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তির পালানোর সম্ভাবনা আছে কিনা, সাক্ষীদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে অভিযুক্তের পক্ষে সাক্ষ্য জালিয়াতি করার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা, উভয় পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিনা তা আদালতকে বিবেচনা করতে হবে। এমনকি মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড যোগ্য অপরাধ সংগঠিত করেছে কেবলমাত্র এই কারণে তাদেরকে কারাগারে রাখার কোনো আইনগত বা নীতিগত বাধ্যবাধকতা নেই।

এই ধারায় আরো বলা হয়েছে জামিন অযোগ্য ক্ষেত্রে জামিন দেওয়ার বিষয়টি আদালতের ইচ্ছাধীন ক্ষমতা যা প্রতিটি মামলার ঘটনা ও অবস্থার ভিত্তিতে সতর্কতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে হবে। এই বিষয়টি আদালতকে অনেকটা স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এই স্বাধীনতার বলে দেশে অনেকে মারাত্মক অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিন পেয়ে যাচ্ছে। আবার শুধুমাত্র জামিন অযোগ্য ধারা বিবেচনায় অনেকে জামিন পাচ্ছেন না।

আইনে জামিনের বিধান এবং আইনের ব্যাখ্যায় যে নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা সম্ভব না হলেও আদালতের উচিত এই নীতিমালা ও আইনের বিধান মেনে জামিন আদেশ দেওয়া।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৬ ধারার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে জামিনযোগ্য ধারায় আসামির জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে আদালতের ইচ্ছাধীন ক্ষমতার কোনো প্রশ্ন নেই কারণ ধারাটির শব্দগুলো আদেশাত্মক। আইনে বলা হয়েছে, জামিনযোগ্য ধারায় জামিন দিতে হবে। কিন্তু দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই এই আইনের চর্চা বিচারকরা করেন না। ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে মানহানির একটি মামলায় আত্মসমর্পণ করার পর তাকে কারাগারে পাঠান ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত। মাসুদা ভাট্টি নামক একজন সাংবাদিকের দায়ের করা মামলায় এই আদেশ দেওয়া হয়েছিল। ব্যাপক সমালোচনার পর ব্যারিস্টার মইনুলকে পরে জামিন দেওয়া হয়।

২০১২ সালে দায়ের করা আরেকটি মামলায় ২০১৪ সালের ১৩ অক্টোবর ব্যারিস্টার আশরাফুল ইসলামকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। সেদিন আদালত ব্যারিস্টার আশরাফুলকে জামিন দেননি। মানহানির অভিযোগে দায়ের করা এই মামলার ধারা ছিল জামিনযোগ্য অপরাধের। তাকে বেশ কিছু দিন কারাগারে থাকতে হয়েছিল।

এই দুটি ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের প্রতি নাখোশ ছিলেন কেউ। আবার ব্যারিস্টার আশরাফুল ইসলাম একটি টকশোতে একজন বিচারপতি সম্পর্কে মন্তব্য করায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। সে কারণেই হয়তোবা অধঃস্তন আদালত আইনি বাধ্যবাধকতা পালন করতে পারেননি।

মিয়া মাহমুদ আলী বনাম রাষ্ট্র মামলায় সুপ্রিম কোর্টের এক সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে সন্তোষজনক জামিনদারের প্রস্তাব, যদি প্রয়োজন হয়, দেওয়া সাপেক্ষে জামিনে মুক্তি পাওয়া অভিযুক্ত ব্যক্তির অলঙ্ঘনীয় অধিকার। উপরোক্ত দুইজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে জামিনযোগ্য ধারায় জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানো তাদের অধিকার মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করা হয়েছে বলে আমি মনে করি। এমন অনেক ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না।

জামিন অযোগ্য ধারায় দায়ের করা মামলায় বছরের পর বছর অভিযুক্তকে হাজতবাসে থাকার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। সুপ্রিম কোর্টের একটি সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে যদি দেখা যায় বিচার অনুষ্ঠান অযথা রকমের বিলম্ব ঘটছে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে হাজতে আছে। বিচারক জানেন না বিচার শেষ কবে হবে? বিচারের অনিশ্চয়তার প্রেক্ষিতে আসামিকে জামিন দেওয়া যাবে। ল, জার্নাল ৫ এমএলআর- এর ১০৫ নম্বর পৃষ্ঠায় এই নজিরটি প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু অধঃস্তন আদালতকে এই নজির অনুযায়ী চর্চা করতে দেখা যায় না।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একটি নজির উল্লেখ করতেই হয়। ল জার্নাল ৪ বিএলসি ১৯৫ তে প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের একটি রায় প্রকাশিত হয়েছে। ওই রায়ে বলা হয়েছে, জামিন অযোগ্য অপরাধ অভিযুক্ত সকল ব্যক্তির সঙ্গে সমান ভাবে ব্যবহার বা আচরণ করতে হবে যদি না এমন বিশেষ অবস্থা বিরাজ করে যা মামলার ঘটনার প্রেক্ষিতে বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। এমন নির্দেশের পরেও অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোন আসামিকে আদালত জামিন দিচ্ছেন আবার একই মামলায় অন্য আসামির জামিন নাকচ করা হচ্ছে।

দীর্ঘদিন আইন ও বিচার বিভাগের বিষয় নিয়ে সাংবাদিকতা করতে এসে অনেক ঘটনাই চোখে পড়েছে। কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় বা দুর্নীতির মামলায় জামিন পেয়ে যাচ্ছেন রাঘববোয়ালরা। অথচ সামান্য কিছু টাকা আত্মসাৎ করে মাসের পর মাস হাজত খাটছেন অনেক ব্যক্তি। একই মামলায় একাধিক আসামি থাকলে তার মধ্য থেকে যদি কেউ জামিন পায় তাহলে অন্যান্য আসামিদেরকেও সহ আসামির শর্তে জামিন দিতে হবে উচ্চ আদালতের এমন অনেক সিদ্ধান্ত আছে। কিন্তু আদালত থেকে সহ আসামির শর্তে জামিন পান না ভুরি ভুরি এমন উদাহরন আছে।

গত কয়েক দশকে দেশে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা হচ্ছে বলে বিরোধী দল থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে। এসব মামলায় দেখা গেছে, এজাহারনামীয় আসামি জামিন পাচ্ছে। অথচ সন্ধিগ্ধ আসামিকে অধঃস্তন আদালত গুলো জামিন দিচ্ছেন না।

জামিন হচ্ছে আইনি হেফাজত থেকে আসামির আইনজীবী এবং অন্য কোন স্থানীয় জামিনদারের হেফাজতে নেওয়া। কাজেই কোনো আসামি যদি মারাত্মক অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত না হয় বা পালিয়ে না যায় তাহলে জামিনটা তার অধিকার। কিন্তু সে ধরনের চর্চা নেই।

জামিনযোগ্য ধারায় কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা তাকে জামিন দিতে পারেন বলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৬ ধারায় উল্লেখ আছে। কিন্তু বাংলাদেশ এরকম জামিন দেওয়ার চর্চা একেবারে নেই বললেই চলে।

জামিনের ক্ষেত্রে আইনের চর্চা না থাকায় যা হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, এক. অভিযুক্ত ব্যক্তির আইনি অধিকার ভূলুণ্ঠিত করা। দুই. বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাওয়া। তিন. বিচার বিভাগ সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হওয়া। চার.বিচারিক নৈরাজ্য সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় ৷

সুত্র:dw.com


Post a Comment

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

Previous Post Next Post