আল্লাহ ন্যায় বিচারক। ন্যায়পরায়ণতা মহান স্রষ্টার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন অসামান্য মর্যাদা দিয়ে, সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে। আল্লাহ চান মানুষ পৃথিবীতে তাদের যাপিত জীবনে ন্যায়পরায়ণতার পরিচয় দেবে। এ পৃথিবীতে যে সব নবী রসুলের আগমন ঘটেছে তারা মানব সমাজে সত্য, সুন্দর, কল্যাণ এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেন।
আল্লাহ স্বয়ং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিয়েছেন। ন্যায় বিচার সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা এবং সৌহার্দ্যরে পরিবেশ বজায় রাখতে অবদান রাখে। যে সমাজে ন্যায়পরায়ণতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সে সমাজের সদস্যরা অন্যায় আচরণের শিকার হয় না। ধনী-গরিব, শাসক-শাসিতের সম্পর্কে সৃষ্টি হয় না বড় ধরনের বৈষম্য। আইনের শাসন ন্যায়ভিত্তিক সমাজের মূল সূত্র বলে বিবেচিত হয়। সমাজের কোনো অংশ আইনের শাসনে উপেক্ষিত হয় না।জাতিসংঘের বিবেচনায় সুশাসনের জন্য ৮টি উপাদানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এগুলো হলো সমাজের সব অংশের অংশগ্রহণমূলক ভূমিকা, আইনের শাসন, জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা, কার্যকরী ও দক্ষ প্রশাসন, দায়বদ্ধতা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের প্রাধান্য। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সমাজের সব অংশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলে কোনো অংশের মধ্যে নিজেদের অবহেলিত হওয়ার মনোভাব উঁকি দিতে পারে না। আইনের শাসন সর্বক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতাকে উৎসাহিত করে। জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকলে দুর্নীতির সুযোগ হ্রাস পায়। ন্যায়বিচার প্রাধান্য পেলে হ্রাস পায় অপরাধ প্রবণতা। স্বচ্ছতা সুশাসনের অন্যতম চাবিকাঠি। কার্যকরী ও দক্ষ প্রশাসন সুশাসনের নিশ্চয়তাই শুধু নয় দেশের ও সমাজের দ্রুত উন্নয়ন নিশ্চিত করে। দায়বদ্ধতা সুষ্ঠুভাবে প্রশাসন পরিচালনার জন্য জরুরি
সমাজে বা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রধান শর্ত হিসেবে কাজ করে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদ, সরকার এবং বিচার বিভাগ একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। একটি দেশকে কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংসদ, সরকার এবং বিচার বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার। আমাদের দেশে এ সম্পর্কের অভাব থাকায় গণতন্ত্র যেমন স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি, তেমনি সংসদ রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়নি। বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পরও সবার জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার তাগিদের ঘাটতি থাকায় সুফল এখনো মূর্তমান হয়নি।
আমাদের দেশ গত এক দশকে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যেভাবে এগিয়েছে তা গর্ব করার মতো। আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের লক্ষ্য ছিল একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। যে কল্যাণ রাষ্ট্রে জনগণের ইচ্ছা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রতি রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে। মানুষ ন্যায় বিচার পাবে। ধনী-গরিব-নির্বিশেষে আইনের শাসন সবার জন্য প্রযোজ্য হবে। আমাদের মুক্তি-সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জীবনভর ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন। নিজে ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ক্ষমতা ভোগ করার চেয়ে দেশবাসীর ক্ষমতায়নকে গুরুত্ব দিয়েছেন। দেশের মানুষের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার পর চার যুগ কেটে গেলেও বঙ্গবন্ধুর সে স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেছে। সাম্প্রতিককালে দেশের মানুষের বৈষয়িক উন্নতি হলেও মানবিকতার দিক থেকে পশ্চাৎপদ অবস্থার অবসান ঘটেনি।
নৈতিকতাকে বলা হয় মানব জীবনের আদর্শ। মানুষ যখন তার বিবেকের তাড়না থেকে কর্তব্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সৎ কাজ করে তখন নৈতিকতাকে উৎসাহিত করা হয়। নৈতিকতা যেহেতু ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিষয়, সেহেতু ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে এর চর্চা বাড়াতে হবে। বিবেকবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে নৈতিক আদর্শকে সমুন্নত করতে হবে। এটি সম্ভব হলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। নিশ্চিত হবে সাধারণ মানুষের কল্যাণ। জনগণের কল্যাণে সরকার যে অর্থ ব্যয় করছে তার সঠিক ব্যয় নিশ্চিত হবে। করোনাকালের ভয়াবহ দুর্যোগে সমাজের গরিব অংশের জন্য সরকারের খাদ্য সহায়তায় যে অনিয়ম হয়েছে, তা এড়ানো সম্ভব হতো নৈতিক বোধ সম্পন্ন মানুষের হাতে তা বণ্টনের দায়িত্ব থাকলে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি আমাদের দেশের স্থানীয় সরকারগুলোতে সে ধরনের লোকের অভাব প্রকট। এ সংকট উত্তোরণের একটিই উপায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সৎ শিক্ষিত এবং নৈতিক বোধ সম্পন্ন মানুষদের বেছে নেওয়া।