মাহে রমজানের বিশেষ দশটি আমল

মহানবি (সা) পবিত্র রমজান মাসে রোজা রাখার পাশাপাশি অন্যান্য অনেক আমলের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন । সহিহ হাদিসের আলোকে বিশেষ দশটি আমলের কথা নিচে বর্ণনা করা হলো। ১) বেশি বেশি দান খয়রাত করা ঃ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, সমগ্র মানব জাতির মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা)সর্বাপেক্ষা দানশীল ছিলেন। রমজান মাসে জিবরাঈল (আঃ) যখন তার সাথে সাক্ষাত করতেন তখন তিনি সর্বাধিক দানশীল হয়ে যেতেন। রমজান মাসে জিবরাঈল (আঃ) প্রতি রাতেই তার সাথে সাক্ষাত করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা)তার কাছে কুরআন শরীফ পড়ে শুনাতেন। এভাবে জিবরাঈল (আঃ) যখন তার সাথে সাক্ষাত করতেন তখন তিনি গতিশীল বায়ুর চেয়েও বেশি দানশীল  হয়ে যেতেন। (বুখারি ঃ ১৮৬৪)।

২) ঝগড়া-বিবাদ, মন্দ কথা, কাজ, আচরণ ইত্যাদি পরিহার করা ঃ
আবু হুরায়রা (রা)  সূত্রে । রাসূলুল্লাহ (সা)বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং তদানুযায়ী আচরণ করা বর্জন করল না, তার পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নেই’। (বুখারি ঃ ১৮৬৫) । আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে। রাসূলুল্লাহ (সা)বলেছেন, রোজা হচ্ছে ঢালস্বরূপ । তাই রোজাদার অশ্লীল কথা বলবে না বর্বর আচরণ করবে না এবং কোন লোক তার সাথে ঝগড়া করতে আসলে সে বলবে আমি রোজাদার । যার হাতে আমার প্রাণ সেই সত্তার শপথ! রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশক /কস্তুরীর সুগন্ধের চেয়েও উত্তম । আল্লাহ বলেন, রোজাদার আমার জন্যই খাদ্য, পানীয় ও কামস্পৃহা বর্জন করে থাকে। তাই রোজা আমার জন্যই এবং আমি নিজেই তার পুরস্কার দিব। (বুখারি ঃ ১৮৫৬)
৩) পরিবারের এবং কাজের লোকদের কাজ হালকা করে দেয়া ঃ সালমান ফারিসী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)শা’বান মাসের শেষের দিকে একবার ভাষণ দিলেন, তিনি বললেন, হে লোকসকল! তোমাদের নিকট একটি সম্মানীত মাস (মাহে রমাজান) উপস্থিত হয়েছে .. . .. .. যে ব্যক্তি এ মাসে দাস-দাসীদের কাজের বোঝা হালকা করে দিবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করবেন । । (বায়হাকী, মিশকাত ঃ ১৯৬৫) ।
৪) একটি রোজাও যেন বাদ পড়ে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা ঃ আবু হুরায়রা (রা)  বলেন, যে ব্যক্তি অসুস্থতা বা ওজর ব্যতিরেকে রমজানের একটি রোজাও ভঙ্গ করবে সে সারা জীবন রোজা রাখলেও তার কাজা আদায় হবে না । (বুখারি : কিতাবুস সাওম, অনুচ্ছেদ :৬৯, আবু দাউদ ঃ ২৩৯৪, তিরমিযি ঃ ৭২৩)। আবু উমামা বাহেলী (রা) সূত্রে । রাসূলুল্লাহ (সা) (স্বপ্নেদৃষ্ট ঘটনায়) বলেছেন, তারা আমাকে আরো সামনে নিয়ে গেল এক দুর্গম পাহাড়ের উপর। সেখানে আমি জাহান্নামীদের বিকট ঘেউ ঘেউ আর্তনাদ শুনতে পেলাম । আমরা আরো সামনে গিয়ে দেখলাম, এমন কিছু লোক যাদেরকে হাঁটুতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের চোয়াল ক্ষতবিক্ষত, যা থেকে অবিরত রক্ত ঝরছে । আমি জিজ্ঞেস করলে, তারা আমাকে জানালো যে, এরা সেসব লোক যারা রোজা পূর্ণ হবার আগে ইফতার করত । (নাসাঈ ফিল কুবরা ঃ ৩২৮৬, সহীহ ইবনে খুজাইমা) । তাহলে যারা ইচ্ছা করে রোজা বাদ দিবে তাদের কী শাস্তি হতে পারে ?
৫) বেশি বেশি করে নেক কাজ করার চেষ্টা করা ঃ নফল নামাজ পড়া (বিশেষত: তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা), কুরআন তিলাওয়াত করা, কুরআন তিলাওয়াত শেখা, নিজে এবং পরিবারের লোকদের জন্য ইবাদতের অভ্যাস গড়ে তোলা। আয়েশা (রা)  বলেন, রমজানের শেষ দশক শুরু হওয়ার সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ (সা) সারারাত জেগে থাকতেন এবং নিজ পরিবারের সদস্যদেরকেও জাগাতেন। আর তিনি নিজেও ইবাদাতের জন্য জোর প্রস্তুতি নিতেন। (বুখারি ঃ ১৯৭৯, মুসলিম ঃ ২৬৫৮)।
উতবা ইবনে ফারক্বাদ (রা) সূত্রে। রাসূলুল্লাহ (সা)বলেছেন, রমজানের প্রতি রাতে একজন আহবানকারী ডাক দিয়ে বলে, হে কল্যাণকামীগণ তোমরা নেক কাজ কর, হে পাপীষ্ঠগণ তোমরা পাপ কাজ থেকে বিরত থাকো । (নাসাঈ ঃ ২১০৬, আর আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে, এতে আরো বলা হয়েছে, এ মাসে আল্লাহর পক্ষ থেকে বহু সংখ্যক জাহান্নামীকে মুক্তি দেয়া হয়। তিরমিযি ঃ ৬৮২,ইবনে মাজাহ ঃ ১৬৪২)। আয়েশা (রা)  বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন সালাত আদায় করতেন তখন এমনভাবে কিয়াম করতেন যে, তার পদযুগল ফুলে ফেটে যেত। এ দেখে আমি তাকে বললাম: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এরূপ করছেন অথচ আপনার পূর্বাপর সমূদয় বিচ্যুতি ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে । তিনি বললেন, হে আয়েশা! আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না ?  (মুসলিম ঃ ৬৮৬৫)। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) সূত্রে। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, রোজা এবং কোরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে । রোজা বলবে হে প্রতিপালক! আমি তাকে খাদ্য ও কাম প্রবৃত্তি হতে দিনের বেলা বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল কর । কোরআন বলবে, আমি তাকে রাত্রিকালে নিদ্রা হতে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল কর । তখন উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে। (বায়হাকী শুআবুল ঈমান, মিশকাত ঃ ১৯৬৩)। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স (রা) সূত্রে। রাসূলুল্লাহ (সা)বলেছেন, রোজা পালনকারীর ইফতারের সময়ের দোয়া ফেরত দেওয়া হয়না। (ইবনে মাজাহ ঃ ১৭৫৩)
৬) বাড়িতে ইসলামিক পরিবেশ ও চর্চা বজায় রাখা ঃ টেলিভিশন/মোবাই বা কম্পিউটারে অশ্লীল গান, নাটক ও সিনেমা না দেখা, এর বিপরীতে কম্পিউটার/মোবাইলে বা ডিভিডিতে ইসলামিক অডিও/ ভিডিও গান/ওয়াজ/ ইসলামিক আলোচনা শোনার ব্যবস্থা করা। আবু হুরায়রা (রা)সূত্রে। রাসূলুল্লাহ (সা)বলেছেন : আল্লাহ তায়ালা আদম সন্তানের জন্য যেনার অংশ লিখে রেখেছেন,যা সে অবশ্যই করবে । সুতরাং চোখের যেনা (বা ব্যভিচার) হচ্ছে দেখা, মুখের যেনা হচ্ছে কথা বলা, হাতের যেনা হচ্ছে স্পর্শ করা, পায়ের যেনা হচ্ছে যেনার স্থানে গমন করা, প্রবৃত্তি তা কামনা করে আর যৌনাঙ্গ তা সত্য অথবা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে (বুখারি ঃ ৬০০২)। আয়েশা (রা)বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)তার বাড়িতে ছবি, ক্রুশ বা ক্রুশের ছবি সম্বলিত কোনো কিছু, কাপড় বা পর্দা যাইহোক না কেন তা রাখতে দিতেন না। তিনি তা খুলে ফেলতেন বা কেটে ফেলতেন । তিনি (সা)বলেন : কিয়ামতের দিন ছবি নির্মাতাদের বেশি আযাব হবে । (বুখারি ঃ ৫৭১৯, মুসলিম ঃ ৫৩৪৫) । আবু তালহা (রা)সুত্রে । রাসূলুল্লাহ (সা)বলেছেন : ‘ফেরেশতারা সেই ঘরে প্রবেশ করে না, যাতে ছবি বা কুকুর থাকে’। (বুখারি ঃ ৫৭১৬) । আবু সাঈদ খুদরী (রা)সূত্রে । রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন ঃ কোন পুরূষ অন্য পুরূষের কিংবা কোন নারী অন্য কোন নারীর সতরের দিকে তাকাবে না । (আবু দাউদ ঃ ৪০১৮) ।
৭) সম্ভব হলে উমরাহ করতে যাওয়া ঃ ইবনে আব্বাস (রা)  সূত্রে । রাসূলুল্লাহ (সা)বলেন, ‘ইন্না উমরাতা ফী রামাদ্বানা হাজ্জাতুন অর্থাৎ রমজান মাসের উমরা হজের সমতুল্য।’ (বুখারি ঃ ১৭৪৭, মুসলিম ঃ ২৯০৮, অপর বর্ণনায় ; রমজান মাসে উমরা পালন, আমার সাথে হজ্ব পালনের সমান । মুসলিম ঃ ২৯০৯) ।
৮) সাহরি খাওয়া ঃ আনাস ইবনে মালিক (রা) সূত্রে। রাসূলুল্লাহ (সা)বলেছেন, তোমরা সাহ্রি খাও, কেননা এতে বরকত রয়েছে’ । (বুখারি ঃ ১৮৮৪, মুসলিম ঃ ২৪২০)। আমর ইবনুল আ’স (রা) সূত্রে। রাসূলুল্লাহ (সা)বলেছেন, আমাদের এবং কিতাবীদের সিয়ামের পার্থক্য হ’ল সাহ্রি খাওয়া । (মুসলিম ঃ ২৪২১,নাসাঈ ঃ ২১৬৫)। আল ইরবায ইবনে সারিয়া (রা) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (সা)আমাদেরকে রমজান মাসে সাহরির সময় ডাকেন এবং বলেন, তোমরা কল্যাণময় ভোরের (সাহরির) খাবারের দিকে দ্রুত আস । (আবু দাউদ ঃ ২৩৩৭,নাসাঈ ঃ ২১৬৪) ।
৯) নিজে ইফতার করা এবং অন্যকে ইফতার করানো ঃ সহল ইবনে সা’দ (রা) সূত্রে। রাসূলুল্লাহ (সা)বলেছেন, যতদিন লোকেরা (সূর্যাস্তের পর) তাড়াতাড়ি ইফতার করবে, ততদিন পর্যন্ত তারা কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে না। (বুখারি ঃ ১৯১৫, মুসলিম ঃ ২৪২৫)। আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, রোজাদারের জন্য দু’টি খুশির বিষয় । যখন সে ইফতার করে তখন একবার, আর একবার যখন জান্নাতে সে তার রবের সাক্ষাত লাভ করবে। (বুখারি ঃ ১৮৬৬, মুসলিম ঃ ২৫৭৮)। সালমান ইবনে আমের (রা) সূত্রে। রাসূলুল্লাহ (সা)বলেন, যখন তোমাদের কেউ রোজা রাখে, তখন খেজুর দিয়ে ইফতার করবে । আর যদি খেজুর না পায়, তবে সে যেন পানি দিয়ে ইফতার করে, কেননা পানি পবিত্র । (আবু দাউদ ঃ ২৩৪৭, তিরমিযি ঃ ৬৯৫)। অন্য রোজাদারকে ইফতার করানো সম্পর্কে যায়েদ ইবনে খালিদ আল-জুহানী (রা) সূত্রে। রাসূলুল্লাহ (সা)বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার জন্যও রোজাদারের অনুরূপ সাওয়াব রয়েছে। কিন্তু এতে রোজাদারের সাওয়াবে কমতি করা হবে না । (তিরমিযি ঃ ৮০৭,হাসান ও সহীহ, ইবনে মাজাহ ঃ ১৭৪৬) ।
১০) তারাবীহর সালাত আদায় করা ঃ আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন,  যে ব্যক্তি ইমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমজানে রাত্রি জাগরণ (তারাবিহ সালাত আদায়) করবে তার পূর্বের (সগীরা) গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে।’ ( বুখারি ঃ ১৯৬৫)। আবু সালমা ইবনে আব্দুর রহমান রঃ সূত্রে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর রমজানের রোজা ফরজ করেছেন, আমি তোমাদের জন্য তারাবীহর নামাযকে সুন্নাত করে দিয়েছি । যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে সাওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে এবং তারাবীহর নামায পড়বে, সে স্বীয় গুনাহসমূহ থেকে সে দিনের ন্যায় পবিত্র হবে, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল । (নাসাঈ ঃ ২২০৮) ।
আসুন আমরা সবাই মাহে রমজানে প্রাণ খুলে উক্ত আমলগুলো করার চেষ্টা করি । মহান আল্লাহ আমাদের সে তৌফিক দান করুন, আমীন।

Post a Comment

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

Previous Post Next Post