সদকাতুল ফিতরের ইতিবৃত্ত ও বিধান

ঈদের দিন সকালবেলায় যিনি সাহেবে নিসাব থাকবেন, সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা বা সমমূল্যের সম্পদের মালিক থাকবেন, তিনি সাহেবে নিসাব বা মালিকে নিসাব। রুপার হিসাবে বর্তমান বাজারমূল্যে এটি ৫০ হাজার টাকা প্রায়। সাহেবে নিসাব ব্যক্তির তাঁর নিজের ও পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে ফিতরা  আদায় করা ওয়াজিব। ছোট-বড় সবারই ফিতরা দিতে হবে। যাঁরা সাহেবে নিসাব নন, তাঁদের জন্যও ফিতরা আদায় করা সুন্নত ও নফল ইবাদত। একে অন্যের ফিতরা আদায় করতে পারবেন।

অসহায় গরিব ফকির মিসকিন যাঁরা জাকাত গ্রহণের যোগ্য, তাঁরাই ফিতরার হকদার। ফিতরা নির্ধারিত খাদ্যসামগ্রী বা তার মূল্যে টাকায়ও আদায় করা যায় এবং অন্য কোনো বস্তু কিনেও দেওয়া যায়। পিতা-মাতা ও ঊর্ধ্বতন এবং ছেলেমেয়ে ও অধস্তন এবং যাঁর ভরণপোষণের দায়িত্ব রয়েছে (যেমন স্ত্রী), তাঁদের ওয়াজিব ফিতরা প্রদান করা যায় না।

আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.)–এর জমানায় আমরা সদকাতুল ফিতর দিতাম এক সা (সাড়ে তিন কেজি প্রায়) খাদ্যবস্তু, তিনি বলেন, তখন আমাদের খাদ্য ছিল: যব বা বার্লি, কিশমিশ বা মোনাক্কা, পনির ও খেজুর। (বুখারি, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২০৪)। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্যবস্তু বা (১) এক সা যব (বার্লি) বা (২) এক সা খেজুর বা (৩) এক সা পনির অথবা (৪) এক সা কিশমিশ।’ (বুখারি, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২০৫)।

সাহাবায়ে কিরাম (রা.) অধিকাংশই খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করতেন। ইবনে কুদামা (র.) আবু মিজলাযের বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)-কে বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা যখন প্রাচুর্য দিয়েছেন আর গম যেহেতু খেজুর অপেক্ষা উত্তম, তবু আপনি খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করছেন কেন?’ এর উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘সাহাবিরা যে পথে চলেছেন, আমিও সে পথে চলা পছন্দ করি।’ হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.)-ও এ পক্ষে মত দিয়েছেন। তখন খেজুর অপেক্ষা গম ও আটার দাম বেশি হওয়া সত্ত্বেও সাহাবিরা খেজুর দ্বারা আদায় করা পছন্দ করতেন। (আল ইসতিযকার, খণ্ড: ৯, পৃষ্ঠা: ৩৫৪)। বর্তমানে খেজুর অপেক্ষা গমের দাম কম এবং গম আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় খাবারও নয়; তাই বিষয়টি গভীর অনুধাবনযোগ্য।

নবী করিম (সা.)-এর যুগে মদিনায় গমের প্রচলন কম ছিল। পরবর্তী সময়ে যখন হজরত উমর (রা.) খলিফা ও হজরত মুআবিয়া (রা.) শামের গভর্নর, তখন মদিনায় গমের প্রচলন হয়। এ সময় হজরত মুআবিয়া (রা.)-এর ব্যাখ্যা ও খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর নির্দেশে গম দ্বারা ফিতরা আদায়ের নিয়ম প্রবর্তন করা হয়। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আমাদের মাঝে ছিলেন, তখন আমরা ছোট-বড়, মুক্ত ক্রীতদাস সবার পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্য, অর্থাৎ এক সা পনির বা এক সা যব বা এক সা খেজুর অথবা এক সা কিশমিশ। আমরা এভাবেই আদায় করতে ছিলাম। একবার মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.) হজ বা ওমরাহ করার জন্য এলেন, তিনি জনগণের উদ্দেশে মিম্বরে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন। তখন তিনি আলোচনা করলেন সে বিষয়, যে বিষয়ে মানুষ প্রশ্ন করেছে। তিনি বললেন, ‘আমি দেখছি শামের দুই মুদ (নিসফ সা বা পৌনে দুই কেজি) আটা সমান হয় (মূল্যমান হিসেবে) এক সা (সাড়ে তিন কেজি) খেজুরের। অতঃপর মানুষ (সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিয়িগণ) এই মত গ্রহণ করলেন।’ (মুসলিম, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৩১৭-৩১৮)।

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জমানায় সাহাবায়ে কিরাম (রা.) সদকাতুল ফিতর আদায় করতেন এক সা যব বা খেজুর বা খোসা ছাড়ানো যব অথবা কিশমিশ। তিনি আরও বলেন, যখন উমর (রা.) খলিফা হলেন আর গমের প্রচলন বাড়ল, তখন উমর (রা.) এসব বস্তুর এক সা এর স্থলে গম নিসফ সা নির্ধারণ করলেন। (আবু দাউদ, পৃষ্ঠা: ২২৭-২২৮)। নাফে (র.) থেকে বর্ণিত, আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, অতঃপর (উমর রা. এর নির্ধারণের পর) পরিবর্তন গ্রহণ করল সাহাবায়ে কিরাম নিসফ সা গম। (আবু দাউদ, পৃষ্ঠা: ২২৮-২২৯)। মাজহাবের ইমামগণ এ বিষয়ে একমত, সদকাতুল ফিতর এক সা (সাড়ে তিন কেজি)। গমের ব্যাপারে নিসফ সা করা হয়েছিল দাম বেশি (দ্বিগুণ) হওয়ার কারণে।

হাসান বসরি (র.) থেকে বর্ণিত, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বসরাতে ভাষণ দিলেন এবং বললেন, তোমরা তোমাদের সদকাতুল ফিতর আদায় করো। তখন লোকজন একে অন্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে লাগল। তিনি বললেন, কারা আছ এখানে মদিনাবাসী? 
আসো তোমাদের ভাইদের বুঝিয়ে দাও, তারা জানে না যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্ধারণ করেছেন ছোট-বড়, মুক্ত দাস, পুরুষ-নারী (সকলের প্রতি) সদকাতুল ফিতর। হাসান বসরি (র.) বলেন, তারপর আলী (রা.) বললেন, আল্লাহ যখন তোমাদের প্রাচুর্য দিয়েছেন তোমরাও উদার হও, গমও এক সা দাও। (নাসায়ি, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২৬৮-২৭০)।

ইমাম আযম আবু হানিফা (র.)–এর মতে সদকাতুল ফিতর যেকোনো খাদ্যবস্তু এক সা; তবে গম হলে নিসফ সা। ইমাম মালিক (র.), ইমাম শাফিয়ি (র.) ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র.)–এর মতে সদকাতুল ফিতর যেকোনো খাদ্যবস্তু এক সা (সাড়ে 
তিন কেজি প্রায়)। (আল ফিকাহ আলা মাযাহিবিল আরবাআহ)।

ইমাম আযম আবু হানিফা (র.)–এর মতেও অধিক মূল্যের দ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা অতি উত্তম; অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরিবদের বেশি উপকার হয়, সেটাই উত্তম ফিতরা। ইমাম মালিক (র.)–এর মতে, খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম এবং খেজুরের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ‘আজওয়া’ খেজুর দ্বারাই আদায় করা বেশি উত্তম। ইমাম শাফিয়ি (র.)-এর মতে হাদিসে উল্লিখিত বস্তুসমূহের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা আদায় করা; অন্য সকল ইমামগণের মতও অনুরূপ। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র.)–এর মতে সাহাবায়ে কিরাম (রা.)–এর অনুসরণ হিসেবে খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম। এ ছাড়া সদকার ক্ষেত্রে সকল ফকিহর ঐকমত্য সূত্র হলো, ‘যা গরিবদের জন্য বেশি উপকারী।’ (আল মুগনি, খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ২১৯; আওজাযুল মাসালিক শরহে মুআত্তা মালিক, খণ্ড: ৬, পৃষ্ঠা: ১২৮)।

ফকিহগণের মতে, যেখানে যা প্রধান খাদ্য, তা দ্বারা আদায় করাই শ্রেয়। অনেক গবেষক ফকিহ মনে করেন, বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য চাল, তাই আমাদের সদকাতুল ফিতর এক সা চাল হতে পারে। মুজতাহিদ ইমামগণের মতে, যেসব খাদ্যবস্তু (ক) সহজে সংরক্ষণযোগ্য, (খ) সহজে বিনিময়যোগ্য ও (গ) বাজারমূল্য স্থিতিশীল থাকে; সেসব খাদ্যদ্রব্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা যায়।

খেজুর বা চাল বিভিন্ন দামের রয়েছে, এর মধ্যে কোনটি দ্বারা ফিতরা আদায় করা হবে? উত্তম হলো সর্বোচ্চ মূল্যের খেজুর বা চালের মূল্যে আদায় করা। তবে ধনীরা সর্বোচ্চ এবং সাধারণ লোকদের মাঝামাঝি মূল্যে আদায় করাই শ্রেয়। ইনসাফ হলো, যাঁরা যে চালের ভাত খান বা যাঁরা যে খেজুর দ্বারা ইফতার করেন, তাঁরা সে সমমানের বা সমমূল্যে ফিতরা আদায় করবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তাই উত্তম, দাতার নিকট যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি।’ (বুখারি, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ১৮৮)।

Post a Comment

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

Previous Post Next Post