মহাগ্রন্থ আল কোরআনে
নবী-রাসূলদের দায়িত্ব সম্পর্কে যেসব বর্ণনা পাওয়া
যায় তার মধ্যে তাযকিয়াহ বা লোকদের জীবনকে
পরিশুদ্ধির কাজ ছিল অন্যতম। আর এই আত্মশুদ্ধির কাজে
মূল চালিকা শক্তি ছিল আল্লাহ'র কালাম আল কোরআন।
আমাদের সমাজের কিছু লোককে দেখা যায় যারা
হেদায়াত লাভের জন্য, আল্লাহ'র নৈকট্য লাভের জন্য
আল্লাহ'র কালাম আল কোরআনের কাছে পথের
সন্ধান না করে এদিক সেদিক যায়; অথচ তাদের হাতের
কাছেই রয়েছে মহাগ্রন্থ আল কোরআন,
আল্লাহ'র নৈকট্য লাভের আসল উৎস আল কোরআন। এ
প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন নিজে বলেন: যারা
জ্ঞানবান মানুষ, তারা তোমার প্রতি তোমার প্রভূর পক্ষ
থেকে অবতীর্ণ এই গ্রন্থের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন
করে যে, এই গ্রন্থই হচ্ছে সত্য, এটিই মানুষকে পরম
পরাক্রান্ত ও প্রশংসিত প্রভূর দিকে নিয়ে যায়।’ -[সূরা আল
সাবা: আয়াত-৬]
পবিত্র কোরআন মজিদের শুরুতে সূরা আল ফাতিহায়
আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন নিজে আমাদেরকে দোয়া
শিক্ষা দিয়েছেন যেন আমরা কেবল তাঁর কাছেই সঠিক
পথের সন্ধান (সিরাতুল মুশতাক্বিম) জানতে চাই।
আমরা আগেই বলেছি, পৃথিবীতে নবী-রাসূলদের
অন্যতম প্রধান মিশন ছিল মানুষের জীবনকে পরিশুদ্ধ
করা। পবিত্র কোরআনে যতবার এই আত্মশুদ্ধির
প্রসঙ্গটি আলোচনা করা হয়েছে ততবারই
অনিবার্যভাবে আলকোরআনের কথা বলা হয়েছে।
যেমন : ‘যেমন আমি তোমাদের প্রতি তোমাদেরই
মধ্য হতে একজন রাসূল পাঠিয়েছি, যে তোমাদেরকে
আমার আয়াত পড়ে শোনায়, তোমাদের জীবনকে
পরিশুদ্ধ ও উৎকর্ষিত করে, তোমাদেরকে কিতাব ও
হিকমাত শিক্ষা দেয় এবং যেসব কথা তোমাদের অজ্ঞাত
তা তোমাদের জানিয়ে দেয়।’ -[বাকারা : ১৫১]
‘তিনি সেই সত্তা যিনি নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন
রাসূল প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদেরকে তাঁর
আয়াতসমূহ পড়ে শোনান, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন
এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেন। অথচ এর
আগে তারা সুস্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত ছিল।’ -
[জুমুয়া : ২]
‘প্রকৃতপক্ষে ঈমানদার লোকদের প্রতি আল্লাহ এ
বিরাট অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদেরই মধ্য হতে এমন
একজন নবী বানিয়েছেন যে তাদেরকে
আল্লাহ'র আয়াত শোনান, তাদের জীবনকে ঢেলে
তৈরি করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা
দেন। অথচ এর পূর্বে এসব লোকই সুস্পষ্ট
গোমরাহির মধ্যে নিমজ্জিত ছিল।-[আল ইমরান : ১৬৪]
মহানবীর বিপ¬বী জীবনাদর্শের দিকে যদি আমরা
তাকাই তাহলে দেখতে পাবো যে চরম পাপাচারে
নিমজ্জিত একটি অধঃপতিত, বর্বর ও অসভ্য
জনগোষ্ঠীকে এমনভাবে পরিশুদ্ধ করলেন যে,
তারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জাতিতে
পরিণত হলেন এবং মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার উৎকর্ষে এতটা
সফল হলেন যে, সমগ্র মানব জাতির সামনেই তারা
চিরকালের আদর্শ হয়ে থাকলেন। জগৎবাসীর সামনে
তারা মানবীয় মাহাত্মের মূর্ত প্রতীক এবং সত্যের
জীবন্ত সাক্ষী হয়ে থাকলেন। মানবতার আদর্শ ও
পথ-প্রদর্শক হয়ে তারা পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিলেন
এবং পথহারা মানুষকে পথের দিশা দিয়ে মানবতার সম্মান ও
গৌরবকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তাঁদের এই কৃতিত্বের
কথা, তাঁদের এই নেতৃত্ব, মাহাত্ম ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা
স্বয়ং আল কোরআনে এভাবে ঘোষিত হয়েছে
-‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবতার কল্যাণের জন্যই
তোমাদের আবির্ভাব। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের
আদেশ কর, অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখো এবং
আল্লাহ'র উপর প্রবল প্রত্যয় নিয়ে চল।’ -[আলে
ইমরান : ১১০]
প্রশ্ন হল কোন যাদুর কাঠির স্পর্শে একজন নিরক্ষর
মানুষ একটি দুধর্ষ, বর্বর, রক্তপিপাষু জাতিকে, একটি চরম
পশু সমাজকে - যেখানে দারিদ্র ও বলাৎকারের ভয়ে
পিতা তার আপন কন্যাকে আতুড় ঘরেই মেরে
ফেলতো কিংবা জীবন্ত মাটিচাপা দিত; যেখানে নারী
ছিল শুধুই ভোগের পণ্য, যেখানে যেনা-ব্যভিচার-
পাপাচার ক্যান্সারের মত পুরো সমাজদেহকে আক্রান্ত
করেছিল, অশি¬লতা, নোংরামির যেখানে কোন সীমা
ছিল না, ছিল না নারীর ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তার কোন
সামান্য নিশ্চয়তা; যার কারণে মেয়ে শিশুর জন্মকে পিতা-
মাতা কখনো স্বাগত জানাতো না; মানুষের জান-মাল-
ইজ্জতের কোন নিরাপত্তা যে সমাজে ছিল না; তুচ্ছ
ঘটনাকে কেন্দ্র করেই যেখানে মাসের পর মাস
বছরের পর বছর মারামারি, খুনাখুনিই লেগেই থাকত; চরম
স্বার্থপরতা আর ভোগবাদী মানসিকতা যাদেরকে
পশুতে পরিণত করেছিল, এমনি শত গোত্রে বিভক্ত ও
ছিন্ন-ভিন্ন একটি ‘ব্যর্থ’ সমাজ ও রাষ্ট্রকে তিনি
কীভাবে পরিশুদ্ধ করে একটি সুসংহত ও
শ্রেষ্ঠজাতিতে পরিণত করলেন? কোন পদ্ধতিতে?
কোন শক্তিতে?
বলাবাহুল্য, ঐশীগ্রন্থ আল কোরআনই হলো সেই
সৌভাগ্যের পরশ পাথর, যার স্পর্শে একটি গৌরবহীন জাতি
গৌরবদীপ্ত হয়, সম্মানহীন জাতি সম্মান লাভ করে।
ঐশী পথনির্দেশ বা হেদায়াত হলো সেই চিরন্তন
আবে হায়াত, যা মানুষের শান্তি ও সমৃদ্ধির অনন্ত উৎস।
আল্লাহ'র নূর বা ঐশী আলোক হলো সেই চিরন্তন
রক্ষাকবচ, যা মানুষের ইজ্জত, সম্মান ও নিরাপত্তার
পাহারাদার। আরবের সেই বর্বর লোকগুলো
আল্লাহ'র কালামকে, তাঁর হেদায়াতকে মাথায় তুলে
ধরেছিল, তারা আল¬াহর আয়াতকে সম্মান করেছিল আর
এ ব্যাপারে মুহাম্মদ (সঃ) কে রাসূল অর্থাৎ
আল্লাহ'র আনুগত্যের ব্যাপারে তাঁকে চরম আদর্শ
হিসেবে গ্রহণ করেছিল। আর আল্লাহ'র কালামের
বিশেষত্ব হচ্ছে - পৃথিবীতে আল্লাহ'র কালামকে যারা
সম্মান করবে বিনিময়ে আল্লাহও দুনিয়া ও আখেরাতে
তাদেরকে সম্মানিত করবেন, গৌরবান্বিত করবেন। এ
প্রসঙ্গে আল্লাহ'র সুস্পষ্ট ঘোষণা :
‘আমার নেক বান্দাগণই পাবে পৃথিবীর উত্তরাধিকার।’ -
[আল আম্বিয়া : ১০৫]
প্রথম মানব-মানবী বাবা আদম আর মা হাওয়াকে
পৃথিবীতে পাঠানোর সময়ও আল¬াহ এ ঘোষণা
দিয়েছিলেন :
‘তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও। এরপর আমার
পক্ষ থেকে যে জীবনবিধান তোমাদের কাছে
পাঠানো হবে - যারা আমার সে হেদায়াতকে মেনে
চলবে তাদের জন্য ভয়-ভীতি ও চিন্তার কোন কারণ
থাকবে না। আর যারা তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করবে
এবং আমার বাণী ও আদেশ নিষেধকে মিথ্যা গণ্য
করবে, তারা নিশ্চয়ই জাহান্নামী হবে এবং সেখানে তারা
চিরদিন থাকবে।’-[বাকারা : ৩৮-৩৯]