কলবের যত আমল আছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; বরং তার মগজ ও স্তম্ভ হলো ইখলাস। আপনাদের নবীর তালবিয়ার একটি বাক্য ছিল এমন ‘হে আল্লাহ, এমন হজ (করার নিয়ত করছি) যাতে নেই রিয়াল বা প্রদর্শনপ্রিয়তা কিংবা সুমা তথা সুনাম অর্জনের আকাক্সক্ষা।’ সুতরাং ইখলাসই দ্বীনের মূলতত্ত্ব। ইখলাসই সব নবী-রাসুলের দাওয়াতের সারাংশ
হে আল্লাহর সম্মানিত ঘরের অতিথি, সদ্য আপনারা হজের কার্যক্রম শেষ করেছেন। হজের করণীয়গুলো সম্পাদন করেছেন। আল্লাহ আমাদের ও আপনাদের কবুল করুন। আপনার হজ করুন কবুল, গোনাহ করুন ক্ষমা, চেষ্টা করুন ধন্যবাদার্হ। আপনাদের ফিরিয়ে দিন নিজ নিজ দেশে পরিবারের মাঝে নিরাপদে ও লাভবান হয়ে। আপনাদের সব অবস্থা শুধরে দিন। আপনাদের প্রত্যাবর্তন ও ফিরে যাওয়াকে করুন নির্বিঘ্নে।
এই মোবারক সময়গুলোতে আপনারা যাতায়াত করেছেন পবিত্র স্থানগুলোতে। শ্রম দিয়েছেন নিজেদের আমলে-ইবাদতে। নিজেদের রবের কাছে ক্ষমা ও কবুলিয়াত প্রত্যাশায়। মহান আল্লাহ এ আমলগুলো সম্পর্কে এরশাদ করেছেন, ‘এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না; কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া।’ (সূরা হজ : ৩৭)। ‘কেউ আল্লাহর নামযুক্ত বস্তুগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে তা তো তার হৃদয়ের আল্লাহভীতি প্রসূত।’ (প্রাগুক্ত : ৩২)। ‘আর তোমরা পাথেয় সঙ্গে নিয়ে নাও। নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম পাথেয় হচ্ছে আল্লাহর ভয়।’ (সূরা বাকারা : ১৯৭)।
একজন মুসলিমের যে বিষয়ে নজর দেওয়া এবং চিন্তাভাবনা করা উচিত, তা হলো তাকওয়া বাস্তবায়ন। আর তাকওয়া বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব, যখন নজর দেওয়া হবে কলবের আমলে। কলবের আমল ঈমানের মহানতম ভিত ও বৃহত্তম খুঁটি। যেমন আল্লাহর ভালোবাসা, তাঁর নবী মুহাম্মদ (সা.) এর মহব্বত, আল্লাহর জন্য নিয়ত খাঁটি করা, তাঁর ওপর ভরসা করা, তাঁর আদেশ পালনে সবর করা, তাঁকে ভয় করা এবং তাঁর কাছে যা আছে, সে বিষয়ে প্রত্যাশা রাখা ইত্যাদি। নবী (সা.) বলেন, ‘জেনে রেখো, দেহের মধ্যে একটি মাংসপি- আছে; সেটি সুস্থ থাকলে পুরো দেহ সুস্থ, পক্ষান্তরে সেটি অসুস্থ হলে পুরো দেহ অসুস্থ। আর তা হলো কলব। আত্মা।’
এদিকে কলবের যত আমল আছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; বরং তার মগজ ও স্তম্ভ হলো ইখলাস। আপনাদের নবীর তালবিয়ার একটি বাক্য ছিল এমন ‘হে আল্লাহ, এমন হজ (করার নিয়ত করছি) যাতে নেই রিয়াল বা প্রদর্শনপ্রিয়তা কিংবা সুমা তথা সুনাম অর্জনের আকাক্সক্ষা।’ সুতরাং ইখলাসই দ্বীনের মূলতত্ত্ব। ইখলাসই সব নবী-রাসুলের দাওয়াতের সারাংশ। ‘তাদের এছাড়া কোনো নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে।’ (সূরা বায়্যিনাহ : ৫)। আল্লাহপাক আরও বলেন, ‘জেনে রাখুন, নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদত আল্লাহরই নিমিত্ত।’ (সূরা জুমার : ৩)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘অতএব, তোমরা আল্লাহকে খাঁটি বিশ্বাস সহকারে ডাক।’ (সূরা গাফির : ১৪)।
ইখলাসের প্রকৃত তাৎপর্য হলো, বান্দার তৃপ্তি ও তৎপরতা একমাত্র, শুধু ও কেবলমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য হওয়া। ইখলাসের নিদর্শন গোপনীয়তা ও নির্জনতা। মুখলিস ব্যক্তি চান না মানুষ তার সরষে পরিমাণ আমলের নেকি সম্পর্কেও অবগত হোক। তেমনি পরোয়া করেন না তিনি মানুষের মন থেকে তার যাবতীয় সম্মান-মর্যাদা চলে যাওয়ারও।
তাই তো আলেমরা বলে থাকেন, ‘মুখলিসের কোনো রিয়া নেই। সত্যবাদীর কোনো আত্মতুষ্টি নেই।’ ওমর বিন খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘যার নিয়ত খাঁটি তার ও মানুষের মাঝে আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান।’ সুফিয়ান সাওরি (রহ.) বলেন, ‘আমি নিজের নিয়তের চেয়ে কঠিন কিছু মোকাবিলা করিনি। নিয়ত আমাকে বারবার পরিবর্তিত করে।’ আবু সুলায়মান দারানি বলেন, ‘ওই ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ, যার একটি পদক্ষেপও খাঁটি যাতে সে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারও সন্তুষ্টি কামনা করেনি।’ আইয়ুব সিখতিয়ানি বলেন, ‘বান্দা কখনোই খাঁটি হয়নি যদি সে খ্যাতি পছন্দ করে।’
ইখলাসে নেকি ও প্রতিদান বৃদ্ধি পায়। যদিও আমলটি ছোট ও স্বল্প। ভেবে দেখুন, বনি ইসরাইলের ওই পতিতা মহিলার গল্প যে কি না একটি কুকুরকে দেখতে পেল কুয়ার পাশে আবর্তিত হতো। পিপাসায় কুকুরটি মরতে বসেছিল। মহিলাটি নিজ পায়ের মোজা খুলে ওটিকে পানি পান করায়। এর উসিলায় তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। হাদিসটি আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বোখারি ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন। ওই লোকটির ঘটনাও ভেবে দেখুন, যে কি না চলতে গিয়ে পথে একটি কাঁটার ডাল দেখতে পায়। তারপর সেটি অপসারণ করে আল্লাহর শোকর আদায় করে। এর উসিলায় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। (বোখারি ও মুসলিমের বর্ণনা)। তেমনি ভেবে দেখুন, গুহায় আটকে পড়া তিন ব্যক্তির ঘটনা। যার বর্ণনাও বোখারি ও মুসলিমের।
ভাবুন তো কেয়ামতের দিন চিরকুট নিয়ে হাজির ওই ব্যক্তির ঘটনা, যখন তার সামনে নিরানব্বইটি খাতা মেলে ধরা হবে। প্রতিটিই দৃষ্টিসীমার মতো বিশাল। তারপর বের করা হবে তার একটি চিরকুট, যাতে রয়েছে কালেমার দুই সাক্ষ্যবাক্য। অতঃপর ওই খাতাগুলো রাখা হবে এক পাল্লায় আর চিরকুটটি আরেক পাল্লায়। খাতাগুলো হালকা দেখা যাবে আর চিরকুটটি ভারী। আল্লাহর নামের চেয়ে কোনো কিছুই অধিক ভারী হবে না। হাকেম হাদিসটি সহিহ মুসলিমের শর্তে বর্ণনা করেছেন। বিষয়কে সত্যায়ন ও ব্যাখ্যা করেছে আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিস। নবী (সা.) কে তিনি জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর নবী (সা.), লোকদের মধ্যে কে আপনার সুপারিশ লাভে ধন্য হবে? তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি খাঁটি অন্তরে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে।’ (বোখারি)।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এ ধরনের হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘এটা ওই ব্যক্তির অবস্থা, যিনি এ আমলগুলো নিয়ে হাজির হবেন ইখলাস ও সততার সঙ্গে। যেমন বলেছে এই চিরকুটওয়ালা ব্যক্তি। অন্যথায় জাহান্নামে থাকা কবিরা গোনাহকারী প্রত্যেকেই তো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলত। অথচ তাদের কালেমা তাদের গোনাহের চেয়ে বেশি ভারী হয়নি। যেমনটি হয়েছে এ চিরকুটধারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে। একই অবস্থা কুকুরকে পানি পান করানো পতিতা নারীর। সে কুকুরকে পান করিয়েছে নিজ অন্তরে বিদ্যমান খাঁটি ঈমানের প্রেরণায়। এ কারণে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় যে পতিতাই কুকুরকে পানি পান করিয়েছে তাকে ক্ষমা করা হবে না। অভিন্ন অবস্থা পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা ব্যক্তির। সে তখন পথ থেকে কাঁটার ডাল সরিয়েছে খাঁটি ঈমানে। যে ঈমান খুঁটি গেড়েছে তার অন্তরে। ফলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের ঈমানের তারতম্য হয় অন্তরে ইখলাস ও ঈমানের অবস্থা অনুপাতে।’ সুনান গ্রন্থগুলোয় বর্ণিত হয়েছে, নবী (সা.) বলেন, ‘বান্দা নামাজ শেষ করে আর তার জন্য লেখা হয় শুধু অর্ধেক, এক-তৃতীয়াংশ, এক-চতুর্থাংশ, এমনকি এক-দশমাংশ নেকি।’ অতএব ক্ষমা, মাগফিরাত ও গোনাহমুক্তি শুধু ওই আমল দিয়েই হয়, আল্লাহ যা কবুল করেন। ‘আল্লাহ ধর্মভীরুদের পক্ষ থেকেই তো গ্রহণ করেন।’ (সূরা মায়িদা : ২৭)।
ইখলাস তৈরিতে সহায়তা করে নানা বিষয়। যেমন তাওহিদ বাস্তবায়ন, আল্লাহর সঙ্গে নির্ভেজাল সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, উত্তমভাবে তাঁর ইবাদত, নিভৃতে তাহাজ্জুদ ও জিকির, গোপন দান, নির্জন ইবাদত, দোয়ায় রোনাজারি, নিরেট শুভাকাক্সক্ষী নেককারদের সঙ্গ এবং এসবের জন্য মেহনত-মোজাহাদা বা কষ্ট-সাধনা করা ইত্যাদি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদের আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরা আনকাবুত : ৬৯)।
১৩ জিলহজ ১৪৩৯ হিজরি মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর আলী হাসান তৈয়ব ৷
Tags:
ধর্ম ও জীবন