যুক্তির নিরিখে পুনরুত্থান

প্রতিটি মুসলমানের জন্য এই বিশ্বাস অন্তরে পোষণ করা অপরিহার্য কর্তব্য যে, মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হয়ে দুনিয়ার জীবনের হিসাব দিতে হবে এবং পার্থিব জীবনের কাজ-কর্ম ও আমলের ভালো-মন্দের ভিত্তিতে পরকালের প্রতিফল প্রদান করা হবে। মৃত্যুর পর এ উত্থিত ও জীবিত হওয়ার বিষয়টিকেই পুনরুত্থান বলে অভিহিত করা হয়। এ পুনরুত্থান ও পুনরুজ্জীবন লাভের বিশ্বাসই বাধা হয়ে দাঁড়ায় অন্যায়, অনাচার, দুর্নীতি, অবিচার ও রকমারি অপরাধের পথে। এ একটি মাত্র ধর্মবিশ্বাসই মানুষের নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত লাগামহীন জীবনাচারের বল্গা টেনে ধরে এবং অনৈতিক ভোগ-বিলাস বর্জন করে তাদের সৎপথে পরিচালিত হতে উৎসাহিত করে।
আজকের যুগের মানুষ প্রচ- যুক্তিনির্ভর! তারা প্রতিটি বিষয়কে যুক্তির মানদ-ে যাচাই করে গ্রহণ করতে চায়। যদি কোনো বিষয় তাদের যুক্তিতে না টিকে কিংবা জ্ঞানের কষ্টিপাথরে বোধগম্য না হয়, তাহলে তারা একে গ্রহণ করতে চায় না। মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের বিষয়টিকেও তারা যুক্তির মানদ-ে পরখ করে দেখতে চায়। আর তাই তো দেখা যায় কাফের, মুশরিক, নাস্তিক, মুরতাদ ও বেঈমানেরা এ পুনরুত্থানকে যুগে যুগে অস্বীকার করে এসেছে। তারা বলেছে, ‘আমরা যখন মরে অস্থি ও মৃত্তিকায় পরিণত হয়ে যাব তখনও কি পুনরুত্থিত হব?’ ‘ফুল যখন শুষ্ক হয়ে গাছ থেকে ঝরে যায় তখন তা কি আর কখনও সজীবতা ফিরে পায়?’
আল্লাহ তায়ালা মহাগ্রন্থ আল কোরআনে পুনরুত্থানের পক্ষে বেশ কিছু বলিষ্ঠ যুক্তি তুলে ধরে কাফের মুশরিক ও পৌত্তলিকদের ভ্রান্ত মত ও বিশ্বাসকে অসার বলে প্রমাণ করেছেন। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা পুনরুত্থানের পক্ষে আল্লাহ তায়ালার চারটি যুক্তি উপস্থাপন করব ইনশাআল্লাহ।
(এক) একটি সর্বজনস্বীকৃত ও স্বতঃসিদ্ধ মূলনীতি হলো যিনি বড় বড় বস্তুরাজি সৃষ্টি করতে পারেন তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তুনিচয়ও অবশ্যই সৃষ্টি করতে পারেন। আর আল্লাহ তায়ালা নভোম-ল, ভূম-ল, সাগর, মহাসাগর, পাহাড়, পর্বত, নদ, নদী, খাল, বিল, তরুলতা, গিরি-উপত্যকাসহ সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং যে মহান সত্তা এসব বড় বড় বস্তু সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি অবশ্যই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষকে পুনরুজ্জীবন দান করতেও সক্ষম হবেন। এই যুক্তিটি আল্লাহ তায়ালা মহাগ্রন্থ আল কোরআনে এভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ‘তোমাদের সৃষ্টি অধিক কঠিন না আকাশের, যা তিনি নির্মাণ করেছেন? তিনি একে উচ্চ করেছেন ও সুবিন্যস্ত করেছেন। তিনি এর রাত্রিকে করেছেন অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং এর সূর্যালোক প্রকাশ করেছেন। পৃথিবীকে এর পরে বিস্তৃত করেছেন।’ (সুরা নাযিআত, আয়াত : ২৭, ২৮, ২৯, ৩০)
অপর এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ভিন্ন ভাষায় আলোচ্য যুক্তিটি তুলে ধরে বলেছেন, ‘মানুষের সৃষ্টি অপেক্ষা নভোম-ল ও ভূম-লের সৃষ্টি কঠিনতর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বোঝে না।’ (সূরা মুমিন, আয়াত : ৫৭); নিখুঁতভাবে সপ্তাকাশ সৃষ্টির বিবরণ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা সূরায়ে মুলকে বলেছেন,
‘তিনি সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তুমি করুণাময় আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টিতে কোনো তফাৎ দেখতে পাবে না। আবার দৃষ্টি ফেরাও; কোনো ফাটল দেখতে পাও কি? অতঃপর তুমি বারবার তাকিয়ে দেখ, তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও পরিশ্রান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে। আমি সর্বনিম্ন আকাশকে প্রদীপমালা দ্বারা সুসজ্জিত করেছি।’ (সূরা মুলক, আয়াত : ৩, ৪, ৫); নভোম-ল ও ভূম-ল সৃষ্টি করে ক্লান্ত না হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে পুনরুত্থিত করার সক্ষমতার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে কোরআন শরিফে এরশাদ করেছেন, ‘তারা কি জানে না যে, আল্লাহ যিনি নভোম-ল ও ভূম-ল সৃষ্টি করেছেন এবং এগুলোর সৃষ্টিতে কোনো ক্লান্তিবোধ করেননি, তিনি মৃতকে জীবিত করতে সক্ষম? কেন নয়, নিশ্চয়ই তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ (সূরা আহকাফ, আয়াত : ৩৩)।
(দুই) আল্লাহ তায়ালা নিপুণ ¯্রষ্টা। তিনি হযরত আদম (আ.)কে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। এরপর নরনারীর মিলনের মাধ্যমে প্রক্রিয়ায় মানবকুল সৃষ্টি করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি পুরুষের শুক্র নারীর গর্ভাশয়ে স্থাপন করে সেই শুক্রবিন্দুকে পরিণত করেছেন রক্তপি-ে। এরপর ক্রমে রক্তপি-কে করেছেন মাংসপি-। এই মাংসপি-ের পর হাড় তৈরি করে একজন সুন্দর অবয়বের অধিকারী মানুষ বানিয়েছেন। যে মহান ¯্রষ্টা এই নিপুণ সৃষ্টির কারিগর তার পক্ষে কি সম্ভব নয় যে, তিনি মানুষকে মৃত্যুর পর পুনরায় সৃষ্টি করবেন? নিম্নোক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তায়ালা এই যুক্তিটিই তুলে ধরেছেন এভাবেÑ
‘মানুষ কি মনে করে যে, তাকে এমনি ছেড়ে দেওয়া হবে? সে কি স্খলিত বীর্য ছিল না? অতঃপর সে ছিল রক্তপি-, অতঃপর আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন এবং সুবিন্যস্ত করেছেন। অতঃপর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন যুগল নর ও নারী। তবুও কি সেই আল্লাহ মৃতদের জীবিত করতে সক্ষম নন?’ (সূরা কিয়ামাহ, আয়াত : ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০)।
(তিন) চৈত্র মাসের প্রখর রোদের প্রচ- উত্তাপে ক্ষেত-খামার ও খাল-বিল ফেটে চৌচির হয়ে যায়। এ সময় বন-বনানী, তরু, লতা, দূর্বাঘাস ও গাছগাছালির পত্রপল্লব শুকিয়ে যাওয়ার ফলে সবুজ-শ্যামল নয়নাভিরাম পৃথিবী মৃত্যুবরণ করে। এরপর আল্লাহ তায়ালা তাতে সবুজের গালিচা বিছিয়ে ফসল ফলিয়ে পৃথিবীকে নবজীবন দান করেন। যিনি এই নির্জীব পৃথিবীকে মৃত্যুবরণ করার পর নবজীবন দান করতে সক্ষম হন তার পক্ষে কি সম্ভব নয় যে, তিনি মানুষের মৃত্যুর পর তাকে পুনরায় নবজীবন দান করবেন? এ যুক্তিটি আল্লাহ তায়ালা সূরায়ে ফাতিরে এভাবে তুলে ধরেছেন, ‘আল্লাহই বায়ু প্রেরণ করেন, অতঃপর সে বায়ু মেঘমালা সঞ্চারিত করে। অতঃপর আমি তা মৃত ভূখ-ের দিকে পরিচালিত করি, অতঃপর তদ্দ¦ারা সে ভূখ-কে তার মৃত্যুর পর সঞ্জীবিত করে দিই। এমনিভাবে হবে পুনরুত্থান।’ (সূরা ফাতির, আয়াত : ৯)।
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেছেন, ‘তিনি মৃত থেকে জীবিতকে বহির্গত করেন ও জীবিত থেকে মৃতকে বহির্গত করেন এবং ভূমির মৃত্যুর পর তাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এভাবেই তোমরা পুনরুত্থিত হবে।’ (সূরা রোম, আয়াত : ১৯)।
আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) তার বিখ্যাত তাফসিরগ্রন্থ তাফসিরে ইবনে কাসিরে বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা অধিকাংশ সময় পুনরুত্থানের প্রমাণ প্রদান করে থাকেন জমিনের মৃত্যুর পর তাকে পুনরায় সজীব করার বিষয়টির মাধ্যমে। যেমন তিনি সূরায়ে হজের প্রারম্ভে তার বান্দাদের সতর্ক করে বলেছেন, তারা যেন জমিনকে জীবন্ত করার বিষয়টির সঙ্গে নিজেদের পুনরুত্থান ও পুনরুজ্জীবনের বিষয়টিকে বিবেচনা ও তুলনা করে। কেননা কোনো কোনো সময় পৃথিবী মৃত, অনুর্বর ও উদ্ভিদশূন্য হয়ে যায়। এরপর আল্লাহ তায়ালা যখন সেখানে মেঘমালা প্রেরণ করে তাতে বারিবর্ষণ করেন, তখন তা সতেজ ও স্ফীত হয়ে যায় এবং সর্বপ্রকার সুদৃশ্য উদ্ভিদ উৎপন্ন করে। ঠিক অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালা মানুষের দেহগুলোকেও জীবন্ত করে তুলবেন। যখন আল্লাহ তায়ালা মানুষদের পুনরুর্জীবিত ও উত্থিত করতে চাইবেন তখন তিনি আরশের নিচ থেকে সমগ্র পৃথিবীতে সমানভাবে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। ফলে সমাধিগুলোতে মানুষের দেহগুলো তেমনিভাবে জীবিত হয়ে উঠবে যেমন সবুজ কোমল তৃণলতা জমিনে উৎপন্ন হয়ে থাকে।’
(চার) প্রকৌশলী ও প্রস্তুতকারকদের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য মূলনীতি হলো কোনো বস্তু প্রথমবার সৃষ্টি করা কঠিন। কিন্তু কোনো বস্তু যখন একবার অস্তিত্বে চলে আসে তখন তাকে পুনরায় তৈরি করা সহজ। এর যন্ত্রাংশ ও নাট বল্টুগুলো যথাস্থানে স্থাপন করলে সহজেই বস্তুটি তৈরি হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালাও এই যুক্তিটি কোরআন শরিফে প্রদান করেছেন যে, আমি যেহেতু মানুষকে প্রথমবার সৃষ্টি করে ফেলেছি তাই তাকে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা আমার জন্য সহজতর। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনিই সৃষ্টিকে প্রথমবার অস্তিত্ব দান করেন, অতঃপর তিনি তাকে পুনরায় সৃষ্টি করবেন। এটা তার জন্য সহজ। আকাশ ও পৃথিবীতে সর্বোচ্চ মর্যাদা তারই এবং তিনিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা রোম, আয়াত : ২৭)
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, ‘বলুন যিনি প্রথমবার সেগুলোকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই জীবিত করবেন। তিনি সর্বপ্রকার সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক অবগত।’ (সূরা ইয়াসিন, আয়াত : ৭৯); হাদিসে কুদসিতেও আলোচ্য যুক্তিটি স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘মানবসন্তান আমার প্রতি মিথ্যারোপ করে, অথচ এ অধিকার তার নেই। সে আমাকে গালিগালাজ করে, অথচ তাকে এ অধিকার প্রদান করা হয়নি। তার মিথ্যারোপের স্বরূপ হলো, সে বলে, ‘আল্লাহ তায়ালা আমাকে কখনও পুনরুত্থিত করবেন না, যেমন তিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন।’ অথচ তার বোঝা উচিত যে, প্রথমবার সৃষ্টি পুনর্বার উত্থানের চেয়ে সহজ নয়। আর আমাকে তার গালি দেওয়ার স্বরূপ হলো, সে বলে, ‘আল্লাহ তায়ালা সন্তান গ্রহণ করেছেন!’ অথচ আমি একক, মুখাপেক্ষীহীন! আমি কাউকে জন্ম দিইনি এবং আমাকেও কেউ জন্মপ্রদান করেনি। আর আমার সমকক্ষ কেউ নেই।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস : ৪৯৭৪)।
শতভাগ বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও চাক্ষুষভাবে প্রত্যক্ষ করার জন্য হজরত ইবরাহিম (আ.) একদিন আল্লাহ তায়ালার কাছে মৃতকে জীবিত করে দেখানোর জন্য আবেদন করেন। তখন আল্লাহ তায়ালা তার সামনে চারটি মৃত পাখিকে জীবিত করে দেখান। এ মর্মে আল কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহিম বলল, হে আমার পালনকর্তা আমাকে দেখাও, কেমন করে তুমি মৃতকে জীবিত করবে। বললেন; তুমি কি বিশ্বাস কর না? বলল, অবশ্যই বিশ্বাস করি, কিন্তু দেখতে এজন্য চাইছি যাতে অন্তরে প্রশান্তি লাভ করতে পারি। বললেন, তাহলে চারটি পাখি ধরে নাও। পরে সেগুলোকে নিজের পোষ মানিয়ে নাও, অতঃপর সেগুলোর দেহের একেকটি অংশ বিভিন্ন পাহাড়ের উপর রেখে দাও। তারপর সেগুলোকে ডাক; তোমার নিকট দৌড়ে চলে আসবে। আর জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, অতি জ্ঞানসম্পন্ন। (সূরা বাকারা, আয়াত : ২৬০)। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অনুযায়ী হযরত ইবরাহিম (আ.) চারটি পাখি জবাই করে সেগুলোকে টুকরা টুকরা করে বিভিন্ন পাহাড়ের চূড়ায় রেখে ডাক দিলে সেগুলো জীবন্ত হয়ে হজরত ইবরাহিম (আ.) এর কাছে উড়ে চলে আসে!
উল্লিখিত আলোচনায় আমরা কোরআন ও হাদিসের যুক্তির আলোকে এ কথা জানতে পেরেছি যে, মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হয়ে পার্থিব জীবনের কর্মনিচয়ের হিসাব নিকাশের সম্মুখীন আমাদের হতে হবে। তাই আমাদের উচিত গড্ডলিকাপ্রবাহে গা না ভাসিয়ে পরজীবনের মুক্তি ও পরিত্রাণের লক্ষ্যে ইহজীবনকে সুন্দর করে ঢেলে সাজানো। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তৌফিক দান করুন! আমিন।

Post a Comment

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

Previous Post Next Post