বাসস্থান মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। মুসলিম-অমুসলিম-নির্বিশেষে সবার ঘরবাড়ি প্রয়োজন।
একটু ঠাঁই ও ঠিকানা জীবনের পরম পাওয়া। তাই সবাই যে যার মতো ঘরবাড়ি বানায়। ছনের ছাউনি, বাঁশের বেড়া, টিনের কারুকাজ থেকে শুরু করে দালানকোঠা ও প্রাসাদ নির্মাণ করে মানুষ একটু আশ্রয়ের জন্য। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে কত কারুকাজখচিত ইমারত নির্মাণ করে মানুষ, তার হিসাব নেই। নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষ ঘরবাড়ি নির্মাণ করবে—এটাই স্বাভাবিক। ইসলাম এ ক্ষেত্রে কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করেনি; কিন্তু ইসলাম সব মুসলমানের ঘরবাড়ির অভ্যন্তরে অভিন্ন পরিবেশ চেয়েছে। মুসলমান কিভাবে ঘরে প্রবেশ করবে, কিভাবে ঘর থেকে বের হবে, ঘরে কিভাবে থাকবে, ঘরে জিনিসপত্র কিভাবে রাখবে এবং ঘরে কী করবে—সব বিষয়ে বিশদ বিবরণ রয়েছে কোরআন ও হাদিসে। এখানে তার কিঞ্চিৎ আলোচনা রইল—
বাড়িতে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলা : বাড়িতে সুন্নাহ মোতাবেক প্রবেশ করলে ও বের হলে বাড়ি শয়তানের কবল থেকে হেফাজতে থাকে। দুনিয়াবি বিভিন্ন ফেতনা-ফ্যাসাদ থেকে মুক্ত থাকে।
নানাবিধ অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশকালে ও খাবার গ্রহণকালে আল্লাহর নাম স্মরণ করলে শয়তান (তার সঙ্গীদের) বলে, তোমাদের রাত্রিযাপন ও রাতের আহারের কোনো ব্যবস্থা (এ ঘরে) হলো না; কিন্তু কোনো ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশকালে আল্লাহকে স্মরণ না করলে শয়তান বলে, তোমরা রাত্রিযাপনের জায়গা পেয়ে গেলে। আহারের সময় আল্লাহকে স্মরণ না করলে শয়তান বলে, তোমাদের রাতের আহার ও শয্যা গ্রহণের ব্যবস্থা হয়ে গেল। ’ (মুসলিম, হাদিস ২০১৮, আবু দাউদ, হাদিস : ৩৭৬৫)
ঘরে প্রবেশকালে সালাম দেওয়া : সালাম দেওয়া এক গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। এ জন্য গৃহে প্রবেশকালে প্রবেশকারী সালাম দেবে, যদিও ওই ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ ওই ঘরে বসবাস না করে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করবে, তখন সশব্দে সালাম করবে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত বরকতময় ও পবিত্র অভিবাদন। ’ (সুরা : নূর, আয়াত : ৬১)
সুন্নাত-নফল সালাত ইবাদত ঘরে আদায় করা উত্তম : রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের জন্য বাড়িতে নামাজ আদায় করা জরুরি। কেননা ফরজ নামাজ ছাড়া লোকেরা ঘরে যে নামাজ আদায় করে, তা-ই উত্তম। ’ (বুখারি, হাদিস : ৭৩১, মুসলিম, হাদিস : ৭৮০)
ঘরে ছবি-মূর্তি না ঝুলানো : ছবি-মূর্তি ইসলামে নিষিদ্ধ। তাই এসব থেকে বাড়িঘর মুক্ত রাখা মুমিনের অন্যতম কর্তব্য; কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, বর্তমানে বেশির ভাগ মুসলমানের ঘর ছবি-মূর্তিতে ভরপুর থাকে। দেয়ালে নিজের, মৃত মা-বাবার, প্রিয় ব্যক্তিত্বের বা নেতার ছবি ঝুলানো থাকে। কখনো নেতার প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্যও শোভা পায় মুসলমানদের ঘরে। কখনো শোভা বর্ধনের নামে বিভিন্ন প্রাণী-মূর্তির শোপিস সাজানো থাকে শোকেস, আলমারি ও কর্নার শেলফে। অথচ এসবের জন্য ইহ ও পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ঘরে কুকুর ও ছবি থাকে, সে ঘরে (রহমত ও বরকতের) ফেরেশতা প্রবেশ করে না। ’ (বুখারি, হাদিস : ৩২২৫, ৩৩২২; মুসলিম, হাদিস : ২১০৬)
বাড়িতে কুকুর প্রতিপালন না করা : বাড়িতে কুকুর প্রতিপালন করা মুসলমানের জন্য বৈধ নয়। আর এ জন্য মুসলমানের নেক আমলের সওয়াব নষ্ট হয়ে যায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ঘরে কুকুর ও ছবি থাকে, সে ঘরে (রহমত ও বরকতের) ফেরেশতা প্রবেশ করে না। ’ (বুখারি, হাদিস : ৪০০২; মুসলিম, হাদিস : ২১০৬)
ঘরে চিতাবাঘের চামড়া ঝুলিয়ে বা বিছিয়ে না রাখা : যেসব জিনিস থেকে ঘর মুক্ত রাখা জরুরি, তার মধ্যে চিতাবাঘের চামড়া অন্যতম। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা রেশম ও চিতাবাঘের চামড়ায় তৈরি গদিতে আরোহী হবে না। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪১২৯)
ঘরে বাদ্যযন্ত্র না রাখা : বর্তমানে ইসলামী জীবনযাপনে যেসব জিনিস অত্যধিক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে, তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্র। সর্বত্র এসবের দৌরাত্ম্য পরিলক্ষিত হয়। আর এসব শোনা ও শোনানোর জন্য বর্তমানে বিভিন্ন উপায়-উপকরণ বের হয়েছে। এসব জিনিস একদিকে মানুষের জীবনযাত্রা অতি সহজ করে দিয়েছে, অন্যদিকে এসবের অপব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে, যা কেউ রোধ করতে পারছে না, অথচ বহু পাপের মূলে এ গান-বাজনা। এর মাধ্যমে অন্তরে মুনাফিকি পয়দা হয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘গান-বাজনা অন্তরে মুনাফিকি সৃষ্টি করে, যেমন পানি সবজি উৎপাদন করে। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯২৭)
অন্যের গৃহে প্রবেশকালে অনুমতি নেওয়া : অন্যের গৃহে প্রবেশকালে অনুমতি নেওয়া জরুরি, এমনকি মায়ের ঘরে প্রবেশের আগেও অনুমতি নিতে রাসুল (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন। তিনবার প্রবেশের অনুমতি চাওয়া হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এরপর অনুমতি না পেলে ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা গৃহে কাউকে না পাও, তাহলে সেখানে প্রবেশ কোরো না—তোমাদের অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত। আর যদি তোমাদের বলা হয় ফিরে যাও! তাহলে তোমরা ফিরে এসো। এটাই তোমাদের জন্য পবিত্রতর। আর আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত। ’ (সুরা : নূর, আয়াত : ২৮)
মেহমানদারির জন্য বাড়িতে আবশ্যকীয় জিনিস রাখা : মানুষ থাকলে তার আত্মীয়-স্বজন থাকবে। বাড়িতে মেহমানও আসবে। তাই মেহমানের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহে রাখা জরুরি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘একটি শয্যা পুরুষের, দ্বিতীয় শয্যা তার স্ত্রীর, তৃতীয়টি অতিথির জন্য আর চতুর্থটি (যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়) শয়তানের জন্য। ’ (মুসলিম, হাদিস : ২০৮৪)
পানাহারে অপচয় থেকে বেঁচে থাকা : অপচয় ও অপব্যয় নিষিদ্ধ। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা খাও ও পান করো; কিন্তু অপচয় কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না। ’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩১)
বাড়ি নির্মাণে প্রতিযোগিতা না করা : বাড়িঘর, অট্টালিকা নির্মাণে প্রতিযোগিতা করা কাম্য নয়। জিবরাইল (আ.) কিয়ামতের আলামত সম্পর্কে প্রশ্ন করলে রাসুল (সা.) বলেন, ‘দাসী তার মনিবকে জন্ম দেবে (অর্থাৎ সন্তান তার মায়ের নাফরমানি করবে); আর তুমি দেখবে যে খালি পা ও খালি গায়ের অধিকারী মুখাপেক্ষী রাখাল শ্রেণির লোকেরা উঁচু উঁচু প্রাসাদ তৈরি করে গর্ব প্রকাশ করবে। ’ (মুসলিম, হাদিস : ৮)
ঘরে কোরআন তিলাওয়াতের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া : বাড়িতে কোরআন তিলাওয়াত বরকত লাভ এবং শয়তান দূর হওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর উপায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের ঘরকে কবর বানিয়ে নিয়ো না। অবশ্যই শয়তান সেই ঘর থেকে পলায়ন করে, যে ঘরে সুরা বাকারাহ পাঠ করা হয়। ’ (মুসলিম, হাদিস : ৭৮০)
ঘরে পরপুরুষ ও নারী নির্জনে অবস্থান না করা : ঘরে নির্জনে পরপুরুষ ও পরনারী একত্রে অবস্থান করা নিষিদ্ধ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নারীদের কাছে একাকী যাওয়া থেকে বিরত থাকো। এক আনসারি ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল! দেবরের ব্যাপারে কী হুকুম? তিনি উত্তর দেন, দেবর হচ্ছে মৃত্যুতুল্য। ’ (বুখারি, হাদিস : ৫২৩২; মুসলিম, হাদিস : ২১৭২) তিনি আরো বলেন, ‘একজন স্ত্রীলোকের সঙ্গে একজন পুরুষ একাকী থাকলে তাদের মধ্যে শয়তান তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে যোগ দেয়। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ১১৭১)
ঘর প্রশস্ত করা : বসবাসের ঘর প্রশস্ত ও বড়সড় হওয়া উচিত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সৌভাগ্যের বিষয় চারটি—সতীসাধ্বী স্ত্রী, প্রশস্ত বাড়ি, সৎকর্মশীল প্রতিবেশী ও আরামদায়ক বাহন। ’ (সহিহ আত-তারগিব, হাদিস : ২৫৭৬) অন্য হাদিসে এসেছে, ‘সুসংবাদ ওই ব্যক্তির জন্য, যে তার জিবকে সংযত করতে সক্ষম হয়েছে, বাড়িকে প্রশস্ত করেছে এবং নিজের পাপের জন্য ক্রন্দন করেছে। ’ (সহিহ আত-তারগিব, হাদিস : ২৮৫৫)
শয্যা গ্রহণের সময় দরজা বন্ধ করা, আগুন নেভানো ও খাবার পাত্র ঢেকে রাখা : ঘুমানোর আগে রাসুল (সা.) কিছু কাজ করতে বলেছেন, প্রত্যেক পরিবারের জন্য তা মেনে চলা জরুরি। কেননা এতে বহু উপকারিতা রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন সন্ধ্যা হয়, তখন তোমাদের সন্তানদের ঘরে আটকে রাখো। কেননা এ সময় শয়তানরা ছড়িয়ে পড়ে। তবে রাতের কিছু অংশ অতিক্রম করলে তখন তাদের ছেড়ে দিতে পারো। আর ঘরের দরজা বন্ধ করবে। কেননা শয়তান বন্ধ দরজা খুলতে পারে না। আর তোমরা আল্লাহর নাম নিয়ে তোমাদের মশকের মুখ বন্ধ করবে এবং আল্লাহর নাম নিয়ে তোমাদের পাত্রগুলো ঢেকে রাখবে, কমপক্ষে পাত্রগুলোর ওপর কোনো বস্ত্র আড়াআড়ি করে রেখে দিয়ো। আর (শয্যা গ্রহণের সময়) তোমরা তোমাদের প্রদীপগুলো নিভিয়ে দেবে। ’ (বুখারি, হাদিস : ৫৬২৩; মুসলিম, হাদিস : ২০১২)
বাড়িকে আল্লাহর জিকিরের স্থানে পরিণত করা : ঘরবাড়ি আল্লাহর জিকিরের স্থানে পরিণত করা প্রতিটি মুসলমানের করণীয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ঘরে আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, আর যে ঘরে আল্লাহকে স্মরণ করা হয় না—এরূপ দুটি ঘরের তুলনা হচ্ছে জীবিত ও মৃতের সঙ্গে। ’ (মুসলিম, হাদিস : ৭৭৯)