মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন হচ্ছে অর্থ। আর এ অর্থ উপার্জন প্রধানত চাকরি কিংবা ব্যবসায়ের মাধ্যমেই হয়ে থকে। ইসলামি ঐতিহ্যের অনন্য মাধ্যম বা পেশা ব্যবসা-বাণিজ্য। হজরত আদম আ: থেকে শুরু করে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: পর্যন্ত সব নবী-রাসূল ব্যবসা-বাণিজ্য পছন্দ করতেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ইসলামি ফিকাহ শাস্ত্রবিদেরা বলেছেন, ‘এই দুনিয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে ব্যবসায় হচ্ছে সবচেয়ে বড় জীবনোপায়ের মাধ্যম। সভ্যতা-সংস্কৃতির উপকরণগুলোর মধ্যে এটা হলো সবচেয়ে বড় উপকরণ।’
ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রেরণা : ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি যে জাতি যত বেশি মনোযোগ দেয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সে জাতি তত বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। পক্ষান্তরে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি যে জাতি বা যে অধিবাসীদের আগ্রহ নেই, তারা সব সময় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অন্যদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। তাই ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি উৎসাহ দিয়েছে। তার ফজিলত ও বরকতের কথা শুনিয়েছে; ইহকালের কল্যাণ ও পরকালের সুসংবাদ দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘নামাজ শেষ হওয়ার পর পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং মহান আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করো।’ (সূরা জুমা : ১০)। এখানে অনুগ্রহের অর্থ জীবিকা ও সম্পদ। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি উৎসাহ দানের উদ্দেশ্যে মূলত আয়াতটি নাজিল হয়েছে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মহানবী সা: ব্যবসায়ীদের অনুপ্রাণিত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা ব্যবসায় করো, ব্যবসায়ে ১০ ভাগের ৯ ভাগ রিজিকের ব্যবস্থা আছে।’
ব্যবসায়ের মূলনীতি : ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও পারস্পরিক কায়কারবারের বৈধতা ও সুষ্ঠুতা নিম্নলিখিত নীতিমালার ওপর নির্ভর করে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে বৈধতা পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর এ জন্য ব্যবসায়িক ব্যাপারে উভয় পক্ষের সহযোগিতা অবশ্যই থাকতে হবে। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘পুণ্য ও আল্লাহভীরুতার পথে একে অপরকে সাহায্য করো। পাপ ও অন্যায় পথে কখনো কারো সহযোগিতা করবে না।’ (সূরা মায়িদা : ২)।
যেকোনো কারবারে উভয় পক্ষের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি অবশ্যই থাকতে হবে। জবরদস্তি সম্মতির কোনো মূল্য নেই। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ বাতিল পন্থায় খেও না। কিন্তু তা ব্যবসার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্মতিতে হলে (কোনো আপত্তি নেই)।’ (সূরা নিসা : ২৯)।
চুক্তি সম্পাদনকারীর মধ্যে যোগ্যতা থাকতে হবে। অর্থাৎ তাকে জ্ঞানী, প্রাপ্তবয়স্ক কিংবা বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ও স্বাধীন হতে হবে। সে অবুঝ, অপ্রাপ্তবয়স্ক, পাগল হতে পারবে না। মহানবী সা: বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির ওপর শরিয়তের বিধান আরোপিত হবে না- পাগল, ঘুমন্ত ব্যক্তি ও অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি।’ (আবু দাউদ)।
কারবারে কোনো প্রকার প্রতারণা, আত্মসাৎ, ক্ষতি ও পাপাচার থাকতে পারবে না। অর্থাৎ ইসলামি শরিয়ত যেসব বস্তুর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে, সেসবের ব্যবহার করা যাবে না। মহানবী সা: বলেছেন, (নিজে) ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং (অন্যকে) ক্ষতিগ্রস্ত করা উচিত নয়।’
ব্যবসার উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় যাতে : নিচে বর্ণিত নীতিমালা ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যকে অসিদ্ধ ও বাতিল করে। যেমন :
সম্পদ বাড়ানো ও মুনাফা অর্জনের এরূপ লেনদেন, যাতে পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতা থাকবে না। একজনের নির্ঘাত লোকসানের মাধ্যমে অপরের মুনাফা অর্জিত হবে। যেমন সর্বপ্রকার জুয়া ও লটারি। কারণ, একপক্ষের লাভ এবং অন্যপক্ষের নিশ্চিত লোকসানের ওপরই এসবের ভিত্তি রচিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে, আপনি বলে দিন এগুলোতে বিরাট পাপাচার রয়েছে।’ (সূরা বাকারা : ২১৯)।
সম্পদ বৃদ্ধি ও মুনাফা অর্জনের যেসব ব্যাপারে উভয় পক্ষের মধ্যে কোনো এক পক্ষের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি পাওয়া যায়নি, বিপাকে পড়ে এবং জবরদস্তি সম্মতিকেই স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি বলে ধরে নেয়া হয়েছে, যেমন সুদের কারবার কিংবা কোনো শ্রমিককে ঠকানো। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ বেচাকেনা (বৈধ ব্যবসায়) হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।’ (সূরা বাকারা : ২৭৫)। মহানবী সা: বলেছেন, ‘শ্রমিকের দেহের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তোমরা তার মজুরি দাও।’
ইসলামের দৃষ্টিতে পাপ এমন কারবার করা অথবা এমন সব বস্তু কেনাবেচা করা, যা মূলত অপবিত্র। যেমন- মদ, মৃতদেহ, প্রতিমা, শূকর প্রভৃতি। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের ওপর মৃতদেহ, রক্ত ও শূকরের মাংস হারাম করা হয়েছে।’ (সূরা মায়িদা : ৩)। হজরত জাবির রা: বলেন, আমি মহানবী সা:কে বলতে শুনেছি, মহান আল্লাহ মদ, মৃতদেহ, শূকর ও মূর্তি বেচাকেনা হারাম করেছেন।’ (নায়লুল আওতার, পঞ্চম খণ্ড)।
উভয় পক্ষের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পরও যেসব লেনদেনে কলহবিবাদের আশঙ্কা থাকে। যেমন- পণ্য অথবা মূল্য কিংবা উভয়টাই অস্পষ্ট রাখা। কী দামে কেনা হলো কিংবা কী বস্তু কেনা হলো, তা স্পষ্ট করে বলা হলো না। অথবা একটা লেনদেনকে দুটোয় পরিণত করা হলো। যেমন যেসব পণ্য দেখা প্রয়োজন, কিন্তু না দেখেই ক্রয় করা হলো।
মহানবী সা: বেচাকেনার সময় অনুপস্থিত বস্তু বেচাকেনা করতে নিষেধ করেছেন (তিরমিজি)।
যেসব লেনদেনে ধোঁকা ও প্রতারণা নিহিত রয়েছে। যেমন- এক ধরনের পণ্য দেখিয়ে অন্য ধরনের পণ্য দেয়া কিংবা বস্তার ভেতরে কমদামি পণ্য রেখে ওপরে দামি পণ্য সাজিয়ে রেখে ক্রেতাকে ধোঁকা দেয়া। মহানবী সা: প্রতারণামূলক লেনদেন নিষেধ করে বলেছেন, ‘যে প্রতারণা করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’
উপার্জন হতে হবে হালাল : প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্য হালাল রুজির সন্ধান করা অবশ্যকর্তব্য। কেননা হালাল সম্পদ বা খাদ্যই হলো ইবাদত কবুলের শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম শর্ত। হালাল উপায়ে অর্জিত ও শরিয়ত অনুমোদিত সম্পদ বা খাদ্য গ্রহণ ছাড়া আল্লাহর দরবারে কোনো ইবাদতই কবুল হবে না। হালাল খাদ্য ভক্ষণ করা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তুসামগ্রী ভক্ষণ করো।’ (সূরা বাকারা : ১৬৮)। মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে মাংস হারাম খাদ্যে প্রতিপালিত হয়েছে, তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আর হারাম খাদ্যে বর্ধিত প্রতিটি মাংসপিণ্ড জাহান্নামেরই যোগ্য।’ (আহমদ, দারেমি, বায়হাকি)।
ব্যবসায় হবে সুদ-ঘুষমুক্ত : সুদ একটি অতি প্রাচীন সমস্যা। ইসলামি সমাজে এটি একটি অমার্জনীয় অপরাধ এবং মারাত্মক ও ধংসাত্মক শোষণের কৌশল। প্রচলিত অর্থে সুদ হচ্ছে সেই বাড়তি অর্থ যা ঋণদাতা, ঋণ পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দিয়ে তারই বিনিময় হিসেবে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে থাকে। অনুরূপভাবে ঘুষ একটি সামাজিক ব্যাধি। সমাজের ক্ষমতাহীন মানুষেরা তার হৃত অধিকার কিংবা অন্যের অধিকারকে করায়ত্ত করার লক্ষ্যে দুর্নীতিপরায়ণ দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে যে অবৈধ অর্থ কিংবা পণ্যসামগ্রী পর্দার অন্তরালে প্রদান করে থাকে তাই ঘুষ কিংবা উৎকোচ নামে পরিচিত। সুদ সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘যারা সুদ খায় তারা সেই ব্যক্তির মতো দাঁড়াবে যাকে শয়তান স্পর্শ করেই পাগল করে দেয়। এটা এ জন্য যে তারা বলে বেচাকেনা তো সুদের মতোই।’ (সূরা বাকারা : ২৭৫)। ঘুষ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘মানুষের ধনসম্পত্তির কিছু অংশ জেনে বুঝে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিচারককে উৎকোচ দিও না।’ (সূরা বাকারা : ১৮৮)।
মহানবী সা: সুদখোর, সুদ প্রদানকারী, সুদি কারবারের সাক্ষী এবং সুদ চুক্তি লেখককে অভিশাপ দিয়েছেন। (বুখারি, মুসলিম)। ঘুষ সম্পর্কে মহানবী সা: বলেছেন, ‘ঘুষ গ্রহণকারী এবং ঘুষদানকারী উভয়ের ওপরই আল্লাহর লানত।’ (বুখারি, মুসলিম)।
ব্যয়ের মৌলিক নীতিমালা : উপার্জিত অর্থ ব্যয়ের খাত মূলত তিনটি। প্রথমত, কী ব্যয় করা হবে। দ্বিতীয়ত, কী পরিমাণ ব্যয় করা হবে। তৃতীয়ত, কোথায় ব্যয় করা হবে।
কী ব্যয় করা হবে? এর উত্তরে বলা যাবে ব্যক্তি হালাল ও পরিত্র পন্থায় যা কিছু উপার্জন করেছে, সেটাই তার ‘জীবিকার পুঁজি’ এবং এটা তার জীবনের ক্রমবিকাশের প্রয়োজনে ব্যবহারোপযোগী।
কী পরিমাণ ব্যয় করা হবে? নিজের হালাল বা বৈধ উপার্জনে প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যয় করা যাবে না। অপব্যয়, অপচয় পরিহার করে পরিমিত ব্যয় করাই হবে ব্যক্তির একান্ত কর্তব্য। কী পরিমাণ ব্যয় করা হবে, এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘পানাহার করো, অপব্যয় করো না।’ (সূরা আরাফ : ৩১)। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘তোমরা কখনো অযথা ব্যয় করো না। (খরচপত্রে) সীমা অতিক্রমকারীরা শয়তানের ভাই (সমতুল্য)।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ২৬-২৭)। মহানবী সা: বলেছেন, ‘আয়-ব্যয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা হলো সচ্ছল অর্থনৈতিক জীবনের অর্ধাংশ।’ (কানযুল উমাল)।
কোথায় ব্যয় করা হবে? নিজের ও পরিবারের ব্যয় নির্বাহের পর সাধ্যানুযায়ী আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং গরিব-দুঃখীদের দুর্দশা লাঘবে অর্থ ব্যয় করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘ধনসম্পদ থেকে পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন, এতিম-মিসকিন ও মুসাফিরদের জন্য যে পরিমাণ ইচ্ছা খরচ করো।’ (সূরা বাকারা : ২১৫)।
শেষ কথা : অর্থপ্রাপ্তির প্রত্যাশা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। ইসলাম হালাল বা বৈধ পথে অর্থ উপার্জনে উৎসাহিত করেছে। আর অবৈধ পথে উপার্জনকে পরিহার করার নির্দেশ দিয়েছে। উপার্জন করতে গিয়ে অনেকেই অনেক সময় হালাল-হারাম চিন্তা করেন না, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। বৈধ পথে এবং আমানত রক্ষা করে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পন্নকারীকে সুসংবাদ প্রদান করতে গিয়ে মহানবী সা: বলেছেন, ‘সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সাথে থাকবে।’ (তিরমিজি)।