রাসুলে পাক (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে তার স্ত্রীর প্রতি ব্যবহারে উত্তম।’ অবশ্য স্ত্রী কখনও যদি ভুল পথে গমন করে, তখন তাকে সৎ উপদেশ দ্বারা সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা স্বামীর দায়িত্ব। কিন্তু এক্ষেত্রে অধিকতর কঠোরতার বদলে কৌশলী হওয়ার জন্য বলা হয়েছে। কারণ পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি আবেগপ্রবণ পৃথিবীতে স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন মানবজীবনের এক পবিত্রতম সম্পর্ক। এ বন্ধন আল্লাহ রব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানব জাতির প্রতি অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। রক্তসম্পর্কহীন সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা দুইটি মানব-মানবীর মধ্যে অকৃত্রিম আন্তরিকতা, প্রেম-ভালোবাসা স্থাপনের মাধ্যমে আমৃত্যু একাত্মতায় বসবাসের আনন্দময় জীবনযাপন, একটি অলৌকিকতাতুল্য ব্যাপার হলেও তা পরম প্রাপ্তির সৌভাগ্যময় বাস্তবতা। একমাত্র পরম করুণাময়ের অপার নেয়ামতেই এটি সম্ভব হয়েছে। যেহেতু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একটি পবিত্র বন্ধন, তাই উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করা এবং তা বজায় রাখার জন্য আল কোরআনে বহু স্থানে আল্লাহ পাক নির্দেশ প্রদান করেছেন। উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্কে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। অপরপক্ষে অশান্তিময় সম্পর্ক তাঁর অসন্তুষ্টির কারণ হয়।
স্বামী-স্ত্রী, অর্থাৎ দাম্পত্য জীবনকে সুখময় করার জন্য উভয়েরই দায়িত্ব রয়েছে। রয়েছে একজনের ওপর অন্যজনের অধিকার, যা তাদের ন্যায্য পাওনা বলা যেতে পারে, যাকে বলা হয় হক। স্বামীর ওপর স্ত্রীর রয়েছে কিছু কিছু হক। স্ত্রীর ওপর স্বামীরও রয়েছে কিছু কিছু হক।
প্রথমে আলোচনা করা যাক স্বামীর ওপর স্ত্রীর হক সম্পর্কে। স্ত্রীর প্রতি কোমল ব্যবহারের জন্য আল্লাহ নির্দেশ করেছেন স্বামীর প্রতি। আল কোরআনের সুরা আরাফের ১৮৯ আয়াতে পুরুষ, তথা স্বামীকে উদ্দেশ করে আল্লাহ বলেন- ‘তিনিই তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন, যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়।’ অর্থাৎ পুরুষের সঙ্গিনী হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে স্ত্রীকে। তাই স্ত্রীর জন্য শান্তি বিধান করা স্বামীর কর্তব্য। এ শান্তি এক পক্ষের জন্য নয়; সঙ্গিনী হিসেবে স্বামীর সুশান্তি বিধানের দায়িত্বও স্ত্রীর ওপর।
উল্লেখিত আয়াতের বিশ্লেষণে তা পরিষ্কার বোঝা যায়। অনুরূপ আরও একটি নির্দেশনা রয়েছে সুরা বাকারার ১৮৭তম আয়াতে। বলা হয়েছে- ‘তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক।’ অর্থাৎ পোশাক শরীরের সৌন্দর্য বর্ধন করে। তেমনি স্বামী-স্ত্রী উভয়ই একে অপরের সৌন্দর্যবর্ধক। আর এটি হতে পারে একে অপরের প্রতি তাদের সুমার্জিত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে।
স্ত্রীর প্রতি সদ্ব্যবহারের জন্য স্বামীকে বারবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পাক কোরআনের বিভিন্ন স্থানে। সুরা নিসার ২০তম আয়াতে স্ত্রীদের প্রতি ব্যবহার সম্পর্কে স্বামীদের লক্ষ্য করে আল্লাহ পাক বলেন- ‘তাদর সঙ্গে সৎভাবে জীবনযাপন করবে। তোমরা যদি তাদের ঘৃণা কর তবে এমন হতে পারে, আল্লাহ যার মধ্যে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন, তোমরা তাকে ঘৃণা করছ।’ উল্লেখিত আয়াত থেকে এটা বুঝতে পারা যায়, স্ত্রীর প্রতি সদ্ব্যবহারের মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত কল্যাণ রয়েছে এবং তার বিপরীত অর্থাৎ অসদ্ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে অকল্যাণ।
স্ত্রীর প্রতি সুন্দর ব্যবহার করার জন্য, সৎ অথবা বৈধ উপায়ে স্ত্রীকে খুশি করার জন্য নবী করিম (সা.) নির্দেশ প্রদান করেছেন। স্ত্রীর নিষ্পাপ মনোরঞ্জনের জন্য কোনো অর্থ ব্যয়ে সওয়াব লাভ হয়।
এ প্রসঙ্গে বোখারি শরিফে উল্লেখ আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো মুসলমান সওয়াব লাভের আশায় তার স্ত্রীর জন্য কিছু ব্যয় করে, সেটি তার জন্য একটি দান হিসেবে বিবেচিত হয়।’ স্ত্রীর প্রতি সদ্ব্যবহার প্রসঙ্গে তিরমিজি শরিফে বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি উত্তম, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করে।’ অবশ্য এ উত্তম ব্যবহার প্রাপ্তির জন্য স্ত্রীর যোগ্যতাও আবশ্যক। স্ত্রী যদি বিশ্বাসিনী এবং সদাচারিণী হয়, সে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। আর এ ধরনের স্ত্রীর কিছু কিছু দোষ অবশ্যই অধর্তব্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো বিশ্বাসী স্বামী কোনো বিশ্বাসিনী স্ত্রীকে ঘৃণা করবে না। তার একটি দোষ পেলে অন্য গুণের কারণে তাকে ভালোবাসবে।’ (মুসলিম)।
ভালোবাসার অন্যতম প্রতিফলন সদ্ব্যবহার। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে ভালোবাসা প্রতিষ্ঠা হয়। তাই স্ত্রীর প্রতি ভালো ব্যবহারের জন্য হাদিস পাকে নির্দেশ আছে। এ ব্যাপারে মেশকাত শরিফে বর্ণিত আছে, রাসুলে পাক (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে তার স্ত্রীর প্রতি ব্যবহারে উত্তম।’ অবশ্য স্ত্রী কখনও যদি ভুল পথে গমন করে, তখন তাকে সৎ উপদেশ দ্বারা সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা স্বামীর দায়িত্ব। কিন্তু এক্ষেত্রে অধিকতর কঠোরতার বদলে কৌশলী হওয়ার জন্য বলা হয়েছে। কারণ পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি আবেগপ্রবণ। তাদের কঠোরভাবে শাসন করতে গেলে এমন কোনো পরিবেশ অথবা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, যার ফল তিক্ত। এ ব্যাপারে উদাহরণ সহকারে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘স্ত্রীদের সৎ উপদেশ প্রদান করবে, কেননা তারা পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্ট। পাঁজরের হাড়ের মধ্যে উপরের হাড় সর্বাপেক্ষা বক্র। যদি তাকে সোজা করতে চাও, তবে তা ভেঙে যাবে। যদি ছেড়ে দাও, তবে তা আারও বক্র হবে। সুতরাং স্ত্রীদের উপদেশ দিতেই থাকবে।’ (বোখারি)।
কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো, সার্বিক ব্যাপারে, সর্বক্ষেত্রে, সর্বসময়ে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সহানুভূতিশীল আর সহমর্মী হওয়া। সব সুখ-দুঃখে, সব অবস্থায় অংশীদার হওয়া। এ ব্যাপারে স্বামীর দায়িত্ব বেশি। এ প্রসঙ্গে হজরত হাকিম বিন মাবিয়া থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, আমার বাবা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পুরুষের ওপর স্ত্রীর কী কী হক আছে?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘যখন সে নিজে খায়, তাকে খাওয়াবে এবং যখন সে নিজে পরে, তাকে পরাবে এবং তার মুখম-লে কোনো আঘাত করবে না। মৃদু শাস্তি ছাড়া প্রহার করবে না। নিজের শয়নঘর ছাড়া অন্য ঘরে তাকে পরিত্যাগ করবে না।’ (আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ)।