সময়ের মূল্য সম্পর্কে কিছু কথা

আল্লাহ তাআলার খাস বান্দাগণ, যাঁরা ইলম ও আমলে বড় হয়েছেন, আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে অনেক উঁচু মর্যাদা দান করেছেন, তাঁদের বড় হওয়ার পেছনে যে সকল মহৎ গুণের ভূমিকা রয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম হল সময়ের প্রতি যত্নশীল থাকা, সময়ের গুরুত্ব দেওয়া এবং সময়মত নিজের কর্তব্য সম্পাদন করা। মানুষের জীবন সময়ের কতগুলো ক্ষুদ্রাংশের সমষ্টি। এই ক্ষুদ্রাংশগুলো ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া মানে জীবনের সমাপ্তি। জীবনের একটি মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়া মানে জীবনের একটি অংশ হারিয়ে ফেলা, যা আর কখনো ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের বয়স বাড়া মানে আমাদের জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে জীবনের যে সময় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা থেকে সেই পরিমাণে কমে যাওয়া। এজন্য তত্ত্ববিদগণ ক্ষয়িষ্ণু জীবনকে বরফের চাকার সাথে তুলনা করেছেন। বরফের চাকা যেমন প্রতি মুহূর্তে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষের পথে এগিয়ে যায় তেমনি জীবনও এক একটি মুহূর্ত অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে এক সময় সম্পূর্ণই ফুরিয়ে যায়। তাই যারা সময়ের মূল্য বোঝেন, তারা জীবনের প্রতিটি পল-অনুপল সচেতনভাবে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে কাজে লাগাতে চেষ্টা করেন। তারা জানেন, সময় সোনার চেয়ে অধিক মূল্যবান। সময়কে কাজে না লাগালেও তা অতিবাহিত হয়ে যায়। কারণ, সময় আর নদীর স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। আমাদের মনীষীগণ সময়ের প্রতি কীরূপ যত্নশীল ছিলেন তা জানার জন্য এখানে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি। হযরত থানবী রহ. হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. একটি পরিচিত নাম। ধর্মীয় জগতে বিশ্বজোড়া তাঁর খ্যাতি। কর্ম ও অবদানের আলোকে তাঁর মহৎ জীবন এমনি প্রদীপ্ত, যাকে পরিচ্ছন্ন আকাশের সূর্যের সাথে তুলনা করলে, তা কমই করা হয়। ধর্মীয় অঙ্গনে তাঁকে চেনেন না এমন লোক পাওয়া মুশকিল। একবার তাঁর আবাসস্থলে তার অতি শ্রদ্ধেয় উস্তায, দারুল উলুম দেওবন্দের তৎকালীন শায়খুল হাদীস শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রহ. মেহমান হন। প্রিয় শাগরেদ আপন উস্তাযের যথাযথ আদর-আপ্যায়ন ও আরাম- বিশ্রামের ব্যবস্থা করার পর যখন তাঁর লেখার সময় হল, তখন তিনি আদবের সাথে আরজ করলেন, হযরত আমি এ সময় কিছু লেখার কাজ করি। হযরত যদি অনুমতি দেন, তবে কিছুক্ষণ লিখে তারপর হযরতের খেদমতে আবার হাজির হব। হযরত শায়খুল হিন্দ রহ. বললেন, অবশ্যই লেখ। আমার কারণে তোমার কাজের ক্ষতি করো না। তবে সেদিন লিখতে গিয়েও লেখার কাজে হযরতে মন বসেনি। তবু নিয়মি কর্মাভ্যাসে ছেদ পড়তে দেননি, যাতে কাজের বরকত হাতছাড়া হয়ে না যায়। তাই সামান্য সময় লিখে আবার উস্তাযে মুহতারামের খেদমতে চলে আসেন। হযরত শায়খ যাকারিয়া রহ. দীনী অঙ্গনে হযরত শায়খ যাকারিয়া রহ.-কে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। তাঁর রচিত হাদীসশাস্ত্র-বিষয়ক রচনাবলি এবং তাঁর দাওয়াতী ও এসলাহী গ্রন্থাবলির জন্য তিনি দীনী মাদরাসাসমূহের ছাত্র-শিক্ষক এবং দীনদার শ্রেণীর কাছে অতি পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর নিয়মিত অভ্যাস ছিল, সকাল বেলায় তিনি লেখার কাজ করতেন। এসময় তিনি হযরত শায়খুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. হযরত মাওলানা আবদুল কাদের রায়পুরী রহ. এবং তাঁর আপন চাচা হযরত মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলবী রহ. ব্যতীত অন্য কাউকে সময় দিতে পছন্দ করতেন না এবং অন্য কারও জন্য তিনি এ সময়টা নষ্ট করতেন না। অবশ্য এ তিনজনের কেউ এসময় উপস্থিত হলে তাঁর জন্য এসময় ব্যয় করতে কুণ্ঠিত বোধ করতেন না। একবারের ঘটনা। হযরত আবদুল কাদের রায়পুরী রহ. তার মেহমান হলেন। সকাল বেলায় নিয়মিত চা নাশতার পর হযরত রায়পুরী রহ- এর খেদমতে অতি আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন। এভাবে প্রায় তিন ঘণ্টা বসে থাকার পর মাথায় এরূপ প্রচ- ব্যথা অনুভব করলেন যে, আর তাঁর পক্ষে বসে থাকা সম্ভব হল না। তখন হযরত রায়পুরী রহ. জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছ? তখন তিনি এক্ষণই ফিরে আসছি বলে হযরত রায়পুরীর নিকট থেকে অনুমতি নেন। সেখান থেকে সোজা গিয়ে তাঁর লেখার কামরায় প্রবেশ করে কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে শুরু করেন। ফলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাঁর মাথা ব্যথা সেরে যায়। এরপর তিনি আবার হযরত রায়পুরী রহ.-এর খেদমতে ফিরে আসেন। তখন হযরত রায়পুরী রহ. তাঁর কাছে উঠে যাওয়ার কারণ জানতে চান। হযরত শায়খ প্রথমে আসল কারণ বলতে দ্বিধান্বিত হলেও হযরত রায়পুরী রহ.-এর সাগ্রহ জিজ্ঞাসার পর আসল কারণ ব্যাখ্যা করেন। তখন হযরত রায়পুরী রহ. বললেন, এজন্যই তো বারবার জিজ্ঞেস করছি এবং কয়েকবার বলেছি যে, আমার কারণে তুমি তোমার নিয়মিত কাজের কোনো ক্ষতি করো না। নিয়মিত অভ্যাসগত কাজ বাধাগ্রস্ত হলে অনেক সময় শারীরিক অসুস্থতাও দেখা দেয়। এরূপ অবস্থা যে-কারও হতে পারে। তাই বড়রা নিয়মিত কাজ যথা নিয়মে পাবন্দীর সাথে পালনের প্রতি যত্নশীল থাকেন। হযরত মাওলানা ইয়াহইয়া রহ. হযরত মাওলানা ইয়াহইয়া রহ. শায়খ যাকারিয়া রহ. এর পিতা। ছাত্র গড়ার আদর্শ কারিগর ও নিয়ম-শৃংখলার পাবন্দীর জন্য এক প্রবাদ পুরুষ। হযরত গাংগুহী রহ. এর দরসে হাদীসের তাকরীর আরবীতে লিপিবদ্ধ করে হাদীসশাস্ত্রের জগতে যে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন, তজ্জন্য ইলমী দুনিয়ার এক বিরাট মুহসিন হিসাবে সর্বজন পরিচিত। তিনি নিজের ব্যক্তিগত দৈনন্দিন জীবনে কঠোরভাবে নিয়ম-শৃংখলা মেনে চলতেন। তাঁর ছাত্র-ভক্ত অনুসারীদেরকেও সময়ের যত্ন ও শৃঙ্খলার প্রতি জোর তাকীদ দিতেন। ঘনিষ্ঠ ছাত্রদেরকে সময়সূচি তৈরি করিয়ে সে অনুযায়ী পাবন্দীর সাথে চলতে উদ্বুদ্ধ করতেন এবং তিনি নিজে আবার সে সবের তদারকি করতেন। হযরত গাংগুহী রহ. হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাংগুহী রহ. যার নামই তাঁর পরিচয়। হাদীস, ফিক্বাহ, ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য এক কিংবদন্তি পুরুষ। মাশায়েখে দেওবন্দের অন্যতম প্রদান মুরুব্বী। হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রহ.-এর বিশিষ্ট খলিফা। আধ্যাত্মিকার জগতে এক মুকুটহীন সম্রাট। তিনি নিজের নির্ধারিত সময়সূচির প্রতি এত বেশি যত্নশীল ছিলেন যে, কোন কাজ এদিক ওদিক হতে দিতেন না। সকাল বেলা হয়ত লোকজন সামনে বসে আছে। এরই মধ্যে তাঁর ইশরাক বা চাশতের নামাজের সময় হয়েছে, তখনই ওযু করে নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। খাওয়ার সময় হলে সোজা উঠে খাবারের ঘরে চলে যেতেন। কথা কম বলতেন। প্রয়োজনীয় কথা বলতে হলে অতি সংক্ষেপে কথা সমাপ্ত করে তাসবীহ পাঠে নিয়োজিত হতেন। কেউ কোন কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতেন। আর কিছু জিজ্ঞেস না করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলেও সেদিক তাঁর খেয়াল থাকত না। হযরত মাওলানা ইয়াকুব নানুতবী রহ. হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ.-এর উস্তাযপুত্র ও একান্ত বন্ধু। দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম সদরুল মুদাররিসীন। ইলমে লাদুনী, বুযুর্গী ও কাশফ-কারামতের জন্য অনন্য খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। তাঁর এক পুত্র মাওলানা আলাউদ্দিন রহ. পিতার জীবদ্দশায় এক কুরবানীর ঈদের দিন ইন্তেকাল করেন। ঈদের নামাজের পূর্ববর্তী সময় মাওলানা আলাউদ্দিন রহ.-এর মুমূর্ষু অবস্থা চলছে। ঈদের নামাজের সময় হল। হযরত মাওলানা ইয়াকুব নানুতবী রহ. বললেন, আল্লাহ তাআলার হাতে সমর্পণ করলাম। তিনি খাতেমা বিল খায়ের নসিব করুন। এ বলে তিনি ঈদের নামাজে চলে গেলেন। নামাজ বিলম্বিত করলেন না। অথচ তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি এমন ছিল যে, তিনি ইচ্ছা করলে ঈদের নামাজের নির্ধারিত সময় একটু পিছিয়ে দিতে পারতেন। এতে কেউ অসন্তুষ্ট হত না। কিন্তু তিনি তা করেন নি। বরং সময় মতো ঈদগাহে পেঁৗঁছে ঈদের নামাজের ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন। হযরত মাওলানা খলীল আহমদ সাহারানপুরী রহ. হযরত শায়খ যাকারিয়া রহ.-এর উস্তায ও শায়খ। হযরত গাংগুহী রহ.-এর খলীফা। উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় ফকীহ ও মুহাদ্দীস। প্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থ সুনানে আবু দাঊদদের ভাষ্যগ্রন্থ বাযলুল মাজহুদ এর প্রণেতা হিসাবে তাঁর রয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি। দীর্ঘদিন মাজাহেরে উলুম সাহারানপুরের প্রধান অভিভাবক ছিলেন। তাঁর পূর্ণ জীবনটাই ছিল নিয়ম-নিগড়ে বাঁধা। তাঁর জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, নিয়ম- শৃঙ্খলার পাবন্দী তাঁর স্বভাবগুণে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। জীবনপথে চলতে গিয়ে যত কঠিন প্রতিকূলতাই তাঁর সামনে আসুক না কেন, তাতে তাঁর নিয়ম-শৃঙ্খলার পাবন্দীতে কোনো ব্যাঘাত ঘটত না। সময়মতো মাদরাসায় উপস্থিতি এবং পাবন্দীর সাথে দরসদানের কাজ ছিল তাঁর কাজের মধ্যে সর্বাধিক অগ্রগণ্য। তাঁর এ নিয়মানুবর্তিতার ফলে মাদরাসার সকল ছাত্র-শিক্ষক- কর্মচারী যথাসময়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন ও নিয়ম-শৃংখলার প্রতি যত্নশীল হয়ে উঠেছিল। কোনরূপ তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণ ব্যতীতই সকলে আপন আপন কাজে ব্যাপৃত থাকতেন। শায়খ হাসানুল বান্না রহ. বিগত শতাব্দীতে মিসরসহ সমগ্র আরব বিশ্বে ইসলামী জাগরণের প্রাণপুরুষ, বাগ্মী ইসলামী চিন্তাবিদ শহীদ হাসানুল বান্না রহ. বলেন, যে সময়ের দাবি বোঝে সে জীবনকে কাজে লাগাতে পারে। কেননা, সময়ের সমষ্টিই তো জীবন। উমারা আল ইয়ামানী রহ. প্রখ্যাত ফিকহবিদ, আরবী কবি ও সাহিত্যিক উমারা আল ইয়ামানী রহ. বলেন, তোমার মূলধন যেহেতু জীবন, তাই অপ্রয়োজনীয় কাজে তা তুমি ব্যয় করো না। আহমদ শাওকী রহ. আধুনিক মিসরের জাতীয় কবি আহমদ শাওকী রহ. বলেন, মানুষের হৃদয়ের স্পন্দনগুলো মানুষকে বলছে, এ জীবন তো কয়েকটি মিনিট ও সেকেন্ডের সমষ্টি। সুতরাং তুমি এসময়ের মধ্যে এমন কিছু কাজ করে যাও, যা তোমাকে তোমার মৃত্যুর পরও স্মরণীয় করে রাখবে। কেননা, মানুষের মৃত্যু-পরবর্তী স্মরণ তার দ্বিতীয় জীবনের নামান্তর। হাফসা বিনতে সীরীন রহ. প্রখ্যাত তাবেয়ী মুহাম্মদ ইবনে সীরীন রহ.-এর বোন, খ্যাতনামা মহিলা তাবেয়ী, বিদুষী নারী, হাফসা বিনতে সীরীন রহ. বলেন, হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের যৌবন থাকতে থাকতেই তোমরা জীবনকে কাজে লাগাও। কেননা, যৌবনই তো প্রকৃত কাজের সময়। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. বিশ্বখ্যাত চার মুজতাহিদ ইমামের অন্যতম, খ্যাতনামা হাদীস বিশারদ, পবিত্র কুরআনের মর্যাদা রক্ষা এবং ইসলামের বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাস সংরক্ষণের জন্য নজিরবিহীন কুরবানী দানকারী ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. বলেন, আমি যৌবনকে এমন একটি বস্তুর সাথে উপমা দিই, যা আমার পকেটে ছিল, তারপর তা হারিয়ে গেছে। যৌবনকে তিনি অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের কাছে থাকা বস্তুর সাথে তুলনা করেছেন। অথচ তিনি সাতাত্তর বছর হায়াত পেয়েছিলেন। সুতরাং যৌবন যতই বিলম্বিত হোক তা অতি সামান্য, আর জীবন যতই দীর্ঘ হোক তা অতি খাটো। জনৈক দার্শনিক বলেছেন, শিশুর জন্মের পর আযান দেওয়া আর মৃত্যুর পর জানাযার নামাজ পড়া একথার প্রমাণ যে, জীবনকাল অতি সংক্ষিপ্ত, যেমন আযান ও নামাজের মধ্যবর্তী সময়। আহমদ ইবনে ফারিস রহ. প্রখ্যাত আরবী ভাষাবিদ ইমাম আহমদ ইবনে ফারিস রহ. বলেন, যদি গ্রীষ্মের উষ্ণতা, হেমন্তের শুষ্কতা, শীতের শৈত্য তোমাকে কষ্ট দেয় এবং বসন্তের সৌন্দর্য তোমাকে আত্মহারা করে তবে আমাকে বল, তুমি কখন জ্ঞান অর্জন করবে। মাহমূদ শুকরী আলুসী রহ. প্রসিদ্ধ তাফসীরগ্রন্থ রূহুল মাআনী প্রণেতা আল্লামা মাহমুদ আলূসীর নাতি, বাগদাদের প্রখ্যাত পণ্ডিত ও আল্লামা মাহমুদ শুকরী আলূসী রহ. ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী এবং সময়ের প্রতি অতিযত্নশীল বিদগ্ধ ব্যক্তি। গ্রীষ্মকালের প্রচ- দাবদাহ এবং শীতকালের শৈত্যপ্রবাহ কোনো কিছুই তাঁকে দরসদান থেকে বিরত রাখতে পারত না। তাঁর বিশিষ্ট ছাত্র আল্লামা শায়খ বাহজা আল-আসরী বলেন, একদিন প্রবল বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়ার কারণে দরসে উপস্থিত হতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম, এরূপ দুর্যোগপূর্ণ দিনে হয়ত তিনি দরসে আসবেন না। কিন্তু পরের দিন আমি যখন দরসে উপস্থিত হলাম তখন তিনি রাগতঃস্বরে বললেন, শীত ও গরমের তীব্রতা যাকে কর্তব্যকর্ম পালনে বাধাগ্রস্ত করে তার পক্ষে কল্যাণের আশা করা কঠিন। কাজের সময় এখনই অনেকে মনে করেন, আগামীতে অবসর সময় পাওয়া যাবে, ব্যস্ততা ও ঝামেলা কমে যাবে, তখন যৌবনের তুলনায় বেশি সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু পরীক্ষিত বাস্তবতা তার বিপরীত। সুতরাং তোমার সময় যতই বৃদ্ধি পাবে, ততই তোমার দায়িত্ব বাড়তে থাকবে। ব্যস্ততা ও জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পাবে। তোমার সময় কমে আসবে। তোমার শক্তি হ্রাস পাবে। আর বার্ধক্যের সময় তো আরও বেশি সংকীর্ণ শরীর আরও বেশি দুর্বল, সুস্থতা আরও বেশি কম, কর্মোদ্যম আরও বেশি হীন। অথচ তখন দায়িত্ব ও ব্যস্ততা আরও বেড়ে যায় এবং আরও তীব্রতর হয়। সুতরাং জীবনের বর্তমান সময়টাকেই তুমি দ্রুত কাজে লাগাও। অনিশ্চিত অবসরের জন্য ঝুলিয়ে রেখো না। কারণ, কোনো পাত্র যেমন খালি থাকে না, তেমনি সময়ও খালি থাকে না। সুতরাং যৌবনই পরিশ্রম ও উপভোগের সময়, আর বার্ধক্য হল দুর্বলতা ও হীনমন্যতার সময়। বার্ধক্যে কর্মের ইচ্ছা থাকলেও শক্তি-সামর্থ্য, সুযোগ-সাহস কোনোটাই অনুকূলে থাকে না। এজন্যই বলা হয়, এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়। ইমাম জাহিয প্রখ্যাত আরবী ভাষাবিদ আবু উসমান জাহিয যখন বার্ধক্যে উপনীত হলেন এবং বার্ধক্যজনিত নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন। তখন তিনি নিজের দুর্বলতা, বার্ধক্য ও রোগযন্ত্রণায় কাতর হয়ে নিজেকে বলতেন, তুমি কি আশা করছ যে, তুমি বৃদ্ধ অবস্থায় যৌবনের শক্তি ও উদ্যম লাভ করবে? তোমার মন তোমাকে মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে। জীর্ণ কাপড় তো নতুন কাপড়ের মতো হয় না। অতএব বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, সফল ও ভাগ্যবান ব্যক্তি সেই, যে তার বর্তমানের প্রতিটি মুহূর্ত ও প্রতিটি সেকেন্ড কল্যাণকর ও ভালো ফলপ্রসূ কাজে ব্যয় করে। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. কর্মহীনতা, বেকারত্ব ও অযথা সময় নষ্ট করাকে খুবই অপছন্দ করতেন। তিনি বলতেন, আমি তোমাদের কাউকে বেকার ও কর্মহীন দেখতে খুবই অপছন্দ করি। না দুনিয়ার কাজে ব্যস্ত থাকে, না আখেরাতের কাজে। আল্লাহ তাআলা সকলকে সময়ের প্রতি যত্নশীল হওয়ার তাওফীক দান করুন।

Post a Comment

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

Previous Post Next Post