"নূহ (আ.) বলেছিলেন, হে আমার প্রতিপালক! আমি আমার জাতিকে রাত-দিন দাওয়াত দিয়েছি। কিন্তু আমার দাওয়াত তাদের পলায়নী মনোবৃত্তিই কেবল বৃদ্ধি করেছে। আপনি যাতে তাদের ক্ষমা করে দেন সে লক্ষ্যে যখনই আমি তাদের দাওয়াত দিয়েছি তখনই তারা তাদের কানের মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়েছে, বস্ত্র দ্বারা নিজেদেরকে আচ্ছাদিত করেছে, হঠকারিতা দেখিয়েছে এবং চরম ঔদ্ধত্যপনা প্রকাশ করেছে (সূরা নূহ ৫-৯)।
ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডল এর মধ্যস্থিত সবকিছুই মহান সৃষ্টিকর্তা একক আল্লাহর সুপরিকল্পনায় সৃষ্টি। এই বিশ্বাসকেই তাওহীদ বলা হয়। তিনি অদৃশ্য থেকে দৃশ্যমান ও অনস্তিত্ব হতে অস্তিত্বে এনেছেন সবকিছুকে। এই উজ্জ্বল নক্ষত্রেরমত সত্যবাণী পৃথিবী নামক গ্রহে বসবাসকারী আশরাফুল মাখলুকাতের নিকট তাঁর পক্ষ হতে প্রত্যেক সমপ্রদায়ের নিকট রসূলকে স্ব স্ব জাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছেন। যাতে তাঁরা নিজ কওমের কাছে পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যাসহ তাবলিগ করতে পারে। "তিনজন শিশু দোলনায় তাওহীদের বাণী প্রচার করেছিলেন। 'ঈসা ইবনে মারইয়াম, সাহেবে জুরাইজ ও একটি শিশু তার মায়ের দুধ পান করছিলেন তখন" (বুখারী হা.৩৪৩৬)। আদম (আ.) এর অবতরণ স্থল সম্পর্কে স্মরণদ্বীপ (শ্রীলংকা) অথবা মক্কার সাফা পাহাড়ে জান্নাত থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। ভূখন্ডের প্রথম দৃঢ়মনা রসূল নূহ (আ.) একাধারে ৯৫০বছর স্বীয় জাতির মধ্যে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছিলেন। পবিত্র কুরআনে ২৯টি সূরার ৪৩স্থানে সম্পূর্ণ কুরআনের এক চতুর্থাংশ সূরায় প্রসঙ্গটি স্থান পেয়েছে। মহান আল্ল¬াহ্ বলেন, "নূহ (আ.) বলেছিলেন, হে আমার প্রতিপালক! আমি আমার জাতিকে রাত-দিন দাওয়াত দিয়েছি। কিন্তু আমার দাওয়াত তাদের পলায়নী মনোবৃত্তিই কেবল বৃদ্ধি করেছে। আপনি যাতে তাদের ক্ষমা করে দেন সে লক্ষ্যে যখনই আমি তাদের দাওয়াত দিয়েছি তখনই তারা তাদের কানের মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়েছে, বস্ত্র দ্বারা নিজেদেরকে আচ্ছাদিত করেছে, হঠকারিতা দেখিয়েছে এবং চরম ঔদ্ধত্যপনা প্রকাশ করেছে। তারপরও আমি তাদেরকে উচ্চঃস্বরে দাওয়াত দিয়েছি। তাদের সামনে প্রকাশ্যে বলেছি এবং সঙ্গোপনেও খুব বলেছি" (সূরা নূহ ৫-৯)। নূহ (আ.) দুনিয়াতে প্রথম রসূল আদম (আ.) এর দশম অথবা অষ্টম অধঃস্তন পুরুষ। আল-কুরআন পাঠান্তে জগদ্বাসী আদি যুগে আল্লাহর গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশ্বের প্রধান ৬টি জাতির ঘটনা জানতে পেরেছে 'কওমে নূহ' 'আদ, ছামূদ, কওমে লূত্ব, মাদইয়ান ও ক্বাওমে ফেরাউন। ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়াহইয়া, ঈসা ইবনে মারইয়াম ও ইদরিস (আ.) "আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষভাবে অনুগ্রহপ্রাপ্ত । নিজ নিজ কওমে দাওয়াত দিয়ে নেকবান্দা ও নবী হিসাবে প্রসিদ্ধিলাভে তারা ধন্য হয়েছেন। হূদ (আ.) দুর্ধর্ষ ও শক্তিশালী 'আদ জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। উল্লে¬খ্য নূহ (আ.)-এর প্লাবনের পরে এরাই সর্বপ্রথম মূর্তিপূজা শুরু করে। আম্মান হতে শুরু করে হাযরা মাউত ও ইয়ামন পর্যন্ত তাদের বসতি ছিল। পবিত্র কুরআনে হূদ (আ.)ও কওমে 'আদ সম্পর্কে ১৭টি সূরায় ৭৩টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। শামদেশে (বর্তমানে সিরিয়ায়) কওমে ছামূদ এর প্রতি হযরত ছালেহ (আ.) ও ইবরাহীম (আ.) বানী ইসরাঈল কওমে বাবেল শহরে এবং পরে ফিলিস্তিনে হিজরত করেন। পুত্র ইসমাঈল ও ইসহাক মক্কায় ও ফিলিস্তিনে তাওহীদের অমীয়বাণী ব্যাপকভাবে প্রচার ও প্রসার ঘটান। অবশেষে এখানেই সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ট নবী মুহাম্মাদ (স.) এর আগমনের ফলশ্রুতিতে দ্বীনের তাবলিগে বিশ্বকে তাওহীদের আলোয় উদ্ভাসিত করেন। দু'শো বছরের পুরা জীবনটাই ছিল কঠিন পরীক্ষায়। নবী (স.) বলেছেন, "মুসলিম, ইহুদী ও খ্রিস্টানদের উপমা হলো কোন এক ব্যক্তি নির্দিষ্ট মজুরীতে একদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করার জন্য একদল লোক নিযুক্ত করল, তারা দুপুর পর্যন্ত। অন্য দল 'আসর পর্যন্ত কাজ করে মজুরির দাবি ছেড়ে কাজ ত্যাগ করল। নিয়োগকর্তা বাকী কাজ পুরা করে পূর্ণ মজুরি গ্রহণ করতে বললে তারা অস্বীকার করে চলে যায়। বাকী কাজ সম্পন্ন করার জন্য তৃতীয় একদল লোক নিযুক্ত করলে তারা সূর্যাস্ত পর্যন্ত বাকী দিনের কাজ করে পূর্ববর্তী দু'দলের পুরো মজুরী নিয়ে নিল। এটাই হল তাদের এবং যে নূরুল ইসলাম (ইসলামের আলো ) কবুল করেছে তার উপমা (বুখারী, হা.২২৭১)। বিশ্বনবী মুহাম্মদ (স.)ও তাঁর আদর্শ তাবলিগ করে যিন্দাদিল মর্দে মুজাহিদরূপী একদল নিবেদিতপ্রাণ লোক তৈরি করেছিলেন। তাদের জোরালো প্রচার-প্রচারণা চালানোর ফলে গোটাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। রসূল (স.) আল্লাহর কসম করে বলেন, ইসলাম সান'আ থেকে হাজরা মাউত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে। একজন তরুণী সে সময় এককী ভ্রমণ করবে কিন্তু আল্লাহ ব্যতীত সে কাউকে ভয় করবে না। তত্কালীন বিশ্বশক্তি কায়সার ও কিসরা এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার সর্বত্র ইসলামের বিজয়ী ঝান্ডা উড্ডীন হয়েছিল। বর্তমানে পৃথিবীতে ৫৬টি দেশে ইসলামের আলো প্রজ্জ্বলিত রয়েছে। ফেরাউনের নিকট মূসা (আ.) দৃঢ়চিত্তে সত্যের দাওয়াত দেন। অহংকারী সৈরাচারী এই শাসকের হূদয়ে তাতে কোনরূপ রেখাপাত করল না। মূসা ও হারূণের (আ.) দাওয়াতী মিশনের একটি বিরাট অংশ সমাপ্ত হল। শাম ও ইরাক অঞ্চলে আবির্ভুত হয়ে হযরত সোলায়মান (আ.) হুদহুদ পাখির মাধ্যমে সাবা প্রদেশের রাণী 'সূর্য পূজারী' সম্রাজ্ঞী বিলক্বীস বিনতুস সারাকে দ্বীনের দাওয়াত দিলে ঈমান গ্রহণ করে যেন মুসলমান হয়ে যান। অগণিত পরীক্ষা আর চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে ইবরাহীমী ঈমানের জ্যোতি বিচ্ছুরিত হলে অশান্ত নমরূদী হুতাশন পুষ্পকাননে পরিণত হয়। কবি সম্রাট ইকবালের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল-'বিশ্বে যদি সৃষ্টি হয় ফের ইবরাহীমী ঈমান, হুতাশনে তবে সৃষ্টি হবে ফের পুষ্পের কানন'। হযরত ঈসা ইবনু মারইয়াম (আ.) পূর্ববর্তী তাওরাত ও পরবর্তী রসূলের সত্যায়নকারী হিসাবে দাওয়াত দিয়ে বলেন, "তোমরা আল্লাহকে ভয় কর আর আমাকে আনুগত্য কর (ইমরান-৫০)। তিনি বাণী ইসরাঈল বংশের সর্বশেষ কেতাবধারী রসূল। তিনি আল্লাহর পবিত্রতম একক সত্যের বাণী প্রচার করে গেছেন ও পুনরায় ফিরে এসে মানুষকে তাওহীদের অমীয়বাণীর দিকে দাওয়াত দেবেন। ইমাম মাহদীর নেতৃত্বে পৃথিবীতে ইসলামী শরী'আত অনুযায়ী শান্তির রাজ্য কায়েম করবেন। মহানবী (স.) স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করে গেছেন, "আমি এমন কোন জিনিস তোমাদেরকে আদেশ করতে বাদ দেয়নি, যা তোমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করতে পারে এবং এমন কোন জিনিস তোমাদেরকে নিষেধ করতে বাদ দেয়নি, যা তোমাদেরকে আল্লাহ থেকে দূরে ও দোযখের নিকটবর্তী করতে পারে।" তাঁকে লক্ষ্য করে আল্ল¬াহ সুবহানাহু ওয়াতা'আলা বলেন, "তুমি বল এটাই আমার পথ, আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করি সজ্ঞানে, আমি এবং আমার অনুসারীগণ, আল্লাহ মহান পবিত্র। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই" (ইউসূফ-১০৮)। যারা তাঁর স্মরণে বিমুখ, শাস্তিস্বরূপ তাদের জীবন-যাপন হবে সংকুচিত। আর কেয়ামতের দিন তারা অন্ধ অবস্থায় উত্থিত হবে। নবী রসূলদের অবর্তমানে এই দাওয়াতী মিশনের দায়িত্ব তার সকল উম্মতের।