আল্লাহর কসম, আল্লাহর শপথ, আল্লাহর
দিব্যি, রমজানে কারও অজুহাত চলবে না।
এতে যে রাতের নামাজের পন্থায় সফল না
হবে, সে যেন সদকার পথে কৃতকার্য হয়। যদি
তা সম্ভব না হয়, তবে তেলাওয়াতের পথে যেন
সফল হয়। তা-ও যদি সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তত
যেন সে নিজের জিহ্বা ও অঙ্গগুলোকে এ
মাসের মর্যাদাহানি থেকে রক্ষা করে
রমজান মাস ‘দায়িত্বপ্রাপ্তদের’ অন্তরের
পরীক্ষার মৌসুম। কে রক্ষা করতে পারে
মাসটির মাহাত্ম্য ও মর্যাদা আর কে না পারে।
এটি শোরগোলের নয়, নত-নম্র হওয়ার; পিছু হটার
নয়, অগ্রসর হওয়ার এবং কদর্য হওয়ার নয়, স্বচ্ছ
হওয়ার মৌসুম। এ এমন মাস, মানুষ যাতে আপন
রবের নির্দেশ পালনার্থে পানাহার ও কাম
চাহিদা বর্জন করে। এরপরও কি কোনো
বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ মাস নিজ স্রষ্টার অপছন্দ
কাজে ব্যয় করতে পারে? খেল-তামাশা কিংবা
এ পবিত্র মাসের মর্যাদা লঙ্ঘন করতে পারে?
‘রমজান মাসই হলো সে মাস, যাতে নাজিল করা
হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত
এবং সত্য পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ
আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য
বিধানকারী।’ (সূরা বাকারা : ১৮৩)।
এই মোবারক মাসের রয়েছে অনেক মর্যাদা,
সৌকর্য ও জ্যোতি, যা মুসলিমদের এ কিতাবে
মুবিন বা সুস্পষ্ট গ্রন্থের তেলাওয়াতে নিবিড়
যতেœ পরিদৃষ্ট ও দীপ্তমান হয়, যা নাজিল
হয়েছিল এ মহান মাসে। যাতে তা হয় মানুষের
জন্য পথপ্রদর্শক এবং সত্য-মিথ্যার মধ্যে
পার্থক্য বিধানে অকাট্য প্রমাণ, যা এ কথার
তাগিদ দেয় যে, মুসলিম উম্মাহর কর্তব্য হলো,
তার ও রবের কিতাবের মাঝে পাঠ, চিন্তা
কিংবা আমলে যেন কোনো অপরিচিতি বা
গ্যাপ না থাকে। কারণ, যে জাতি পড়ে কিন্তু
চিন্তা করে না, তা চুঙ্গি বা ছোট চোঙের
মতো। আর যে জাতি পড়ে ও চিন্তা করে কিন্তু
আমল করে না, তা অভিশপ্ত জাতি। পক্ষান্তরে
যে জাতি পড়া ও চিন্তা ছাড়া আমল করে তা
পথভ্রষ্ট জাতি। কেন নয়? আল্লাহ তায়ালা তার
কিতাবে বলেছেন, ‘আমাদের সরল পথ দেখাও,
সেই সব লোকের পথ, যাদের তুমি নেয়ামত দান
করেছ। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার
গজব নাজিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট
হয়েছে।’ (সূরা ফাতিহা : ৬-৭)। আয়াতে তারাই
গজবপ্রাপ্ত, যারা জ্ঞানার্জন করেছে অথচ সে
অনুযায়ী আমল করেনি আর তারাই পথভ্রষ্ট যারা
আমল করে না জেনেই।
পবিত্র মাহে রমজান সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ভুল
ধারণা প্রবল আকার ধারণ করেছে। রমজান
যেখানে ঐকান্তিক প্রয়াস, প্রচেষ্টা ও
ইবাদতের মাস, তারা একে মনে করেছে
আলসেমি ও নির্লিপ্ততার মাস। রমজান
যেখানে সিয়াম ও কৃচ্ছ্র সাধনার মাস, কিছু
লোক একে মনে করছে খাবার টেবিল ও
খাদ্যদ্রব্যে নান্দনিক ও বৈচিত্র্যের মাস।
রমজান যেখানে তুচ্ছ বিষয় থেকে ঊর্ধ্বে ওঠা,
জিকির, নামাজ ও কোরআনের জন্য অবসর
হওয়ার মাস। বাচাল উদাসীন ও অকর্মারা মনে
করছে গল্প, ধাঁধাঁ আর টিভি সিরিয়ালের মাস।
এটি এই মাসের সময় ও স্থানগত মর্যাদার
পরিপন্থী।
মহাসত্যবাদী ও সত্য হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত
সত্তা, তার জন্য আমার বাবা-মা কোরবান হোক।
এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও
মিথ্যার মাধ্যমে আমল করা ও মূর্খতা পরিত্যাগ
করতে পারেনি, তার পানাহার ত্যাগ করায়
আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বোখারি) লা
ইলাহা ইল্লাল্লাহ! কল্যাণ, বরকত ও রহমতের
মাসে মিথ্যা ও মূর্খতায় পতিত হওয়া লোকের
সংখ্যা কতই না বেশি! এরা মুস্তাফা (সা.) এর
বাণীকে পিঠের পেছনে স্থান দিয়েছে! এতে
করে তাদের সিয়াম থেকে প্রাপ্তি শুধু ক্ষুধা ও
পিপাসা। রাতের তারাবি থেকে অর্জন শুধু
ক্লান্তি ও জাগরণ।
মনে রাখবেন, রমজান প্রতিযোগিতার ময়দান;
কিন্তু এ বড় দ্রুত প্রস্থানকারী। রমজান
হাতছাড়া হয় শুধু অলসতা ও উদাসীনতায়। রমজান
লুফে নেয়া যায় শুধু সাধনা ও সবরের মাধ্যমে।
এতে ক্লান্তি অর্জনকারী আখেরাতে আরাম
পাবে, এতে ত্রুটিকারী অলস আখেরাতে
ক্লান্তি লাভ করবে। রমজান এসেছে কর্মময়
বানানোর জন্য, কাটিয়ে দেয়ার জন্য নয়। যাতে
আমাদের কারও পরে গিয়ে পস্তাতে না হয়।
আখেরাতে যেন রোজাদারদের লাভের
বাজারে নিজেকে এ মাসে পানাহার ও অনর্থক
কাজে ব্যস্ত ও ডুবে থাকায় সবচেয়ে বোকা ও
মন্দ পরিণতিতে আবিষ্কার করতে না হয়।
আল্লাহর বান্দারা, জেনে রাখুন, পবিত্র মাহে
রমজানে এখলাসের পর মানুষ সবচেয়ে বড় যে
আমল সম্পাদন করে তা হলোÑ সালাত, সিয়াম,
জিকির, কোরআন তেলাওয়াত ও কাতর
প্রার্থনায় সংখ্যা ও গুণগত দিক থেকে
রাসুলুল্লাহ (সা.) এর আদর্শের অনুসরণ করা। এটা
সমীচীন নয় যে, রমজান মাসটি অন্য মাসের
মতোই হবে। রমজানে দান-সদকা অন্য মাসে
দানের মতো হবে না। এতে রাতের নামাজ অন্য
মাসের রাতের নামাজের মতো হবে না। এতে
বদান্যতা অন্য মাসে বদান্যতার মতো হবে না।
এতে কোরআন তেলাওয়াত অন্য মাসে
তেলাওয়াতের মতো হবে না (সবগুলোই রমজানে
বেশি হবে এবং নিখুঁত হতে হবে)।
আল্লাহর কসম, আল্লাহর শপথ, আল্লাহর দিব্যি,
রমজানে কারও অজুহাত চলবে না। এতে যে
রাতের নামাজের পন্থায় সফল না হবে, সে যেন
সদকার পথে কৃতকার্য হয়। যদি তা সম্ভব না হয়,
তবে তেলাওয়াতের পথে যেন সফল হয়। তা-ও
যদি সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তত যেন সে নিজের
জিহ্বা ও অঙ্গগুলোকে এ মাসের মর্যাদাহানি
থেকে রক্ষা করে। আল্লাহর কসম, আল্লাহর শপথ,
আল্লাহর দিব্যি, যে রমজানকে বরবাদ করল সে
কতই না বরবাদগ্রস্ত! যে একে হারাল সে কতই
না সর্বহারা! ‘জেনে রাখো, এটাই সুস্পষ্ট
ক্ষতি।’ (সূরা জুমার : ১৫)।
অতঃপর আরও জেনে রাখুন, এই পবিত্র মাসের
আবহাওয়ায় সবচেয়ে উজ্জ্বল আমল হলো দয়া ও
পরস্পর মায়ার বৈশিষ্ট্য। এ মাসে স্বভাব কোমল
থাকে। অন্তর কোমল থাকে। ফলে রোজাদার
ব্যক্তি নিজের ভেতর পশুত্ব নয় মনুষ্যত্ব জাগরূক
দেখে। তাই সচ্ছল লোকরা যেন এ মাসে আল্লাহ
যা দিয়েছেন তা থেকে ব্যয় করে। একে
খাওয়ায় এবং ওকে বস্ত্র পরায়। যাতে সে
দ্বীনের দুর্গে প্রবেশ করতে পারে, যে
ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন, ‘অতঃপর সে ধর্মের
ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি। আপনি জানেন, সে
ঘাঁটি কী? তা হচ্ছে দাসমুক্তি অথবা দুর্ভিক্ষের
দিনে অন্নদান। এতিম আত্মীয়কে অথবা ধূলি-
ধূসরিত মিসকিনকে।’ (সূরা বালাদ : ১১-১৬)।
আল্লাহ ওই ব্যক্তির ওপর রহম করুন, যে
আল্লাহকে যোগ্য মূল্যায়ন করে। তার জন্যই
নিজের কথাকে সুন্দর করে, রোজাকে সংরক্ষণ
করে, অন্যকে নিষ্ঠার সঙ্গে আহার করায় এবং
উত্তমরূপে সালাত আদায় করে। এটা করে
একমাত্র নবী (সা.) এর ওয়াদার প্রতি বিশ্বাস
রেখে। তিনি বলেন, ‘জান্নাতের মধ্যে কিছু
কক্ষ রয়েছে, যার বাইরের অংশ ভেতর থেকে
এবং ভেতরের অংশ বাইরে থেকে দেখা যায়।
সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, কক্ষগুলো কাদের
জন্য হবে হে আল্লাহর রাসুল? তিনি বললেন, যে
ব্যক্তি নরম কথা বলে, অন্ন দান করে ও লোকরা
যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন সালাতে রত হয়Ñ তার
জন্য।’ (আহমাদ, তিরমিজি)।
৩০ শাবান ১৪৩৮ হিজরি মক্কার মসজিদে
হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত
ভাষান্তর আলী হাসান তৈয়ব