ভারত উপমহাদেশে
হিন্দু জমিদারির
ইতিহাস, মানবতার এক
কলংকজনক ইতিহাস।
যুগ যুগ ধরে
মুসলমানদের
ইতিহাসের পাতায়
যেটা কলংকের এক কালো অধ্যায় হয়ে
থাকবে। কেননা, ইংরেজ বেনিয়ারা
এদেশের ওলামায়ে কেরাম এবং ধর্মপ্রাণ
মুসলমানদেরকে দমন করে, তাদের ক্ষমতার
মসনদকে পাকাপোক্ত করার জন্য যতগুলো
মাধ্যম গ্রহণ করেছিল, তন্মধ্যে জমিদারি
প্রথাও একটি। ওরা ওদের পছন্দের হিন্দু
ব্যক্তিদরেকে “খোদায়ী মালিকানা”
দিয়ে বিভিন্ন এলাকার জমিদার বানিয়ে
দিত। এসব জমিদারদের কাজ ছিল মূলত
দু’টি। এক. ইংরেজ শাসকদের তাবেদারি
করা। দুই. মুসলমানদের অর্থ সম্পদ লুণ্ঠন
এবং জুলুম নির্যাতনের মাধ্যমে
মুসলমানদের দমিয়ে রাখা। সেজন্যই প্রিয়
পাঠক, আপনি কখনো যদি মুক্তাগাছার
জমিদার বাড়ি দেখতে যান, তাহলে
সেখানে সুন্দর সুন্দর ‘অন্দর মহল’ এবং
‘জান্নাতি নহর’ দেখতে পাবেন।
জিজ্ঞেস করলে কর্তৃপক্ষ গলার আওয়াজ
সামান্য নীচু করে বলবে- “সপ্তাহের
যেদিন জমিদার এখানে আসতেন, সেদিন
তার সম্মানার্থে এই নহরগুলো দুধ দিয়ে
ভরে দেয়া হত। যে হাতির ওপর চড়ে তিনি
আসতেন সেই হাতির খাবার ছিল,
মুক্তাগাছার বিখ্যাত পালের ঘরের
মুণ্ডা। আর ওই যে ‘অন্দর মহল’ দেখতে
পাচ্ছেন, সেটা ছিল জমিদারের বিনোদন
রুম। এলাকার কোন মেয়ে যুবতী হলে,
বাবা-মা বাধ্য হত নিজের হাতে নিজের
মেয়েকে সেই বিনোদন রুমে
দিয়ে আসতে।” কত নির্মম ইতিহাস। কিন্তু
তারপরও আমরা জমিদারদের কলংকের
চিহ্ণ এসব জমিদার বাড়িকে ‘কসাইবাড়ি’
বা ‘ধর্ষণ বাড়ি’ হিসেবে ঘৃণার চোখে
দেখিনা। ইতিহাসবিস্মৃত জাতি বলে
কথা। যাই হোক এসব জামিদারদের একজন
ছিলেন আমার শ্রদ্বেয় শিক্ষক জীবন
স্যারের পিতা, তার জীবনের বৈপ্লবিক
পরিবর্তনের উপাখ্যানই আজকে এখানে
উল্লেখ করব।
তিনি ছিলেন জামাল পুরের সর্বশেষ
জমিদার। নাম তার ভোলানাথ চৌধুরী।
অন্য দশজন জমিদারের মতোই মানুষের
ওপর জোর জুলুম করা ছিল তার পেশা।
আত্মগরিমা ও আত্মাহংকারে বুদ হয়ে
থাকা ছিল তার নেশা। বিলাসিতার এমন
কোনো পদ্ধতি ছিল না যা তিনি জানতেন
না। অপরাধ জগতের এমন কোনো অপরাধ
ছিলনা যা তিনি করতেন না। ধন-সম্পদ,
ঐশ্বর্য প্রাচুর্যই ছিল তার জীবনের
একমাত্র চাওয়া। ভোগ-বিলাস আর আরাম-
আয়েশই ছিল জীবনের সবচে বড় পাওয়া।
এমন যার স্বভাব, মনুষ্যত্বের অভাব তার
ভেতরেই একবার জেগে ওঠল জ্ঞান চর্চার
নেশা। সকালে যাবেন তো দেখবেন ঘুম
থেকে ওঠতে ওঠতে বই পড়ছেন। রাতে
যাবেন, তো দেখবেন বই পড়তে পড়তে
ঘুমুতে যাচ্ছেন। যতই বই পড়তে লাগলেন,
জ্ঞানের নতুন নতুন দিগন্ত তার কাছে ততই
উম্মোচিত হতে লাগল। যতই জানতে
লাগলেন অজানাকে জানার পিপাসা
তার ততোই তীব্রতর হতে থাকল। এক সময়
তার সংগ্রহের সমস্ত বই পড়া শেষ হয়ে
গেল। তখন তিনি তার এক ঘনিষ্ট মুসলমান
বন্ধুর কাছে বই চাইলেন। চেহারায়
বিস্ময়ের একরাশ ছাপ নিয়ে মুসলমান বন্ধু
জিজ্ঞেস করলেন “আমাদের ধর্মীয় বই
আপনার ভালো লাগবে তো!” যাই হোক,
তিনি হযরত ওমর রা. এর জীবনীমূলক একটি
বই জমিদার সাহেবকে এনে দিলেন।
বইপ্রেমি মানুষ হাতে নতুন বই পেলেন
মানে, আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। যতই
পড়তে লাগলেন তার কাছে ততই ভিন্ন রকম
মনে হতে লাগল। যেন অন্যসব বই, অন্যসব
মানুষের জীবনীর সাথে এই বই এবং এই
মহামানুষের জীবনীর যথেষ্ট ব্যবধান
রয়েছে। আবার যখন নিজের জীবনের
সাথে ওমর রা. এর জীবনধারাকে
মিলাতে চেষ্টা করলেন তার কাছে
ততোই যেন বিরাট একটা অমিল ধরা
পড়তে লাগল। পড়তে পড়তে নিম্নের
বানীগুলোতে এসে চোখ স্থির হয়ে গেল।
বিবেকের আদালতে আত্মজিজ্ঞাসার
এক তুমুল ঝড় শুরু হয়ে গেল। এমন কথা তিনি
যেন জীবনে এই প্রথম শুনলেন- “পৃথিবীতে
অর্থ ও সম্পদ মানুষকে কখনো মহৎ করতে
পারে না। হযরত ওমর রা. ছিলেন অর্ধ
পৃথিবীর বাদশা, কিন্তু তা সত্ত্বেও তার
মধ্যে অহংকারের কোনো লেশ মাত্র
ছিলনা, তিনি মাটিতে পাটি বিছিয়ে
শুয়ে থাকতেন, কখনো খালিমাটিতে
খালি দেহেও ঘুমিয়ে থাকতেন।”
কথাগুলো তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো
কয়েকবার পড়লেন। যতবার পড়লেন নিজের
বিবেকের আদালতে নিজেকে বড়
অপরাধী মনে হল। নিজের বিবেক যেন
তিরষ্কারের স্বরে জিজ্ঞেস করল-
“যেখানে অর্ধ পৃথিবী
সেখানে জামালপুর তো একেবারেই
ক্ষুদ্র। যেখানে অর্ধ পৃথিবীর বাদশাহী
সেখানে জামলপুরের জমিদারি তো
নিতান্তই তুচ্ছ। এই ক্ষুদ্র জামালপুর আর
তুচ্ছ জমিদারি পেয়েই কেন তোমার মধ্যে
এত অহংকার এত আত্মগরিমা।” ভাবনার
তরঙ্গে তিনি দুলছেন, তবুও পড়া থামালেন
না। পড়তে লাগলেন- “পৃথিবীতে যে মানুষ
যত বেশি সম্পদের অধিকারী, কিয়ামতের
দিন তার হিসাবও তত বেশি হবে। আর যে
লোক অর্থের অহংকারে অন্ধ, সে লোক
কখনোই বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে
না।” এর পর তিনি আর পড়তে পারলেন না।
চোখ বন্ধ করে বইটাও বন্ধ করে ফেললেন,
সারারাত শুধু ছটফট করছেন। কী করবেন-
ভেবে পাচ্ছেন না। এবার যেন তার
ভেতরের মুনষ্যত্ববোধ জেগে ওঠল।
আত্মার শব্দহীন করুণ ডাক তিনি যেন
শুনতে পেলেন- “হে ভুল পথের অভিযাত্রী।
আর কত? এখনো কি তোমার সময় হয়নি
মিথ্যাকে বর্জন করার। সত্যকে গ্রহণ
করার?” সত্য সে আবার কোনটি! আমি কি
সত্যের ওপর নই! প্রতিমার নামে প্রসাদ
উৎসর্গ করে এজীবনে কত সম্পদ উজাড়
করে দিলাম। কত প্রতিমার কত পূজা করে
পুরো জীবনটাই ব্যয় করে দিলাম।
ভগবানের অর্চনা করে করে আজ জীবনের
পড়ন্ত বেলায় এসে উপনীত। তবুও বুঝি
পেলাম না সত্যের পথ। হলাম স্বর্গের
পথের অভিযাত্রী! দোহাই তোমার
ভগবান! আমাকে কৃপা কর। আমি জমিদারি
চাই না; তোমাকে পেতে চাই। আমি
ঐশ্বর্য চাই না, তোমার স্বর্গে যেতে
চাই। তুমি আমাকে সত্য পথের সন্ধান দাও!
ভগবানের কৃপা হল। সত্যকে চিনতে তার
কষ্ট হল না। রাত প্রায় শেষ। আঁধারের বুক
চিরে পূর্ব আকাশে প্রভাতের সূর্য উকি
দিচ্ছে। তার মনের কুফুরের অন্ধকারও
ধীরে ধীরে ঘুচে যাচ্ছে। একসময়
সারাজাহান আলোকিত করে নতুন দিলেন
নতুন সূর্যের উদয় হল। তার মনের আকাশের
কুফুরির সকল অন্ধকারকে মিটিয়ে দিয়ে
ঈমানের আলো জ্বলে ওঠল। নিত্যদিনের
মতো আজকে আর সূর্যের পূজা করলেন না।
সূর্যের মালিকের শোকরিয়া আদায়
করলেন। কালিমা পড়ে সত্যিকার অর্থের
মুসলমান হলেন। শোষণের জমিদারি
ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করলেন। নিজের
ভাগের ১০০ কোটি টাকার সম্পত্তি
ফেলে রেখে চলে এলেন মুক্তাগাছায়।
এটা ১৯৬৬ সালের কথা। এর পর যতদিন
জীবিত ছিলেন, সম্পদের প্রতি তার
এতটাই ঘৃণা ছিল যে, মৃত্যু পর্যন্ত এক ইঞ্চি
জমিও তিনি ক্রয় করেন নি। এভাবেই
তিনি দুনিয়ার সম্পদকে দু’পায়ে দলে
আখেরাতের সম্পদকে কুলে তুলে
নিয়েছেন। দুনিয়া ছেড়ে তিনি চলে
গেছেন আজ থেকে বহুবছর আগে। দুনিয়ার
মানুষ হয়তো তাকে মনে রাখেনি। কিন্তু
আরশের যিনি মালিক, আর যার সন্তুষ্টি
অর্জনের জন্যই তার এত ত্যাগ, এত
বিসর্জন, তিনি কিন্তু কিছুই ভুলেন না।
এবান্দার সকল আমলই তার কাছে
সংরক্তিত আছে। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর
এবান্দাকে জান্নাতের বাদশাহি দান
করেছেন। হে মহান সাধক! কামনা করি,
তোমার কবরের ওপর চিরদিন যেন বর্ষিত
হয় করুণাময়ের করুণার শিশির। হাশরের
মাঠে নবীজীর হাতের কাউসারের পানি
যেন তোমার প্রথম আপ্যায়ন, এবং
জান্নাতী হুরের মুখের নির্ঝর হাসি,
চোখের তির্যক চাহনি এবং আল্লাহর
দর্শন লাভই যেন হয় তোমার শেষ
প্রতিদান। সেই সাথে কামনা করি,
ক্ষমতার মোহে আজ যারা অন্ধ, সম্পদের
লোভে যারা আজ জালিম-শোষক, তোমার
জীবনী থেকে তারা যেন শিক্ষা নেয়।
তাদের যেন শুভবুদ্ধির উদয় হয়। আমিন।