হতাশা শব্দটি একটি বিশেষ্যপদ, যাকে ইংরেজিতে ফ্রাস্টেশন বা ডিপ্রেশন বলা হয়। আমাদের কোন ইচ্ছে পূরণ না হলে, কাজের আশানূরুপ ফল না পেলে বা এমন অন্যান্য নেতিবাচক কারণগুলোতে যেই মানসিক অবসাদের সৃষ্টি হয় তাই হতাশা।
হতাশা আমাদের জীবনের খুব পরিচিত একটি শব্দ। জীবনে চলার পথে বিভিন্ন প্রাপ্তির বিষয়গুলো যেমন আনন্দে উদ্বেলিত করে, তেমনি কখনো কোন অপ্রাপ্তির বেদনায় বা লক্ষ্য অর্জনের ব্যর্থতায় হতাশা আমাদের গ্রাস করে নেয়।
আজ সমাজে সবশ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে হতাশা নানা রকমভাবে বিরাজমান। কিন্তু ইসলাম মানুষকে হতাশ হতে নিষেধ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আল্লাহর অনুগ্রহ হতে নিরাশ হইয়ো না।” –সুরা যুমার, আয়াত : ৫৩
বিখ্যাত পণ্ডিত ইমাম গাযালী (রহ.) বলেছেন, প্রতিটি বেদনা বস্তুত একটি একটি সম্ভাবনা। বিপদে-আপদে হতাশ না হয়ে ধৈর্য ধারণ করো এবং ইতিবাচক দৃষ্টিতে বিপদের মোকাবেলা করো। বাংলা সাহিত্যের একজন বিখ্যাত কবি বলেছেন – মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সুর্য হাসে।
জীবনের কোনকিছুই স্থায়ী নয়। কিন্তু একটা কথা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই যে, জীবনে দুঃখও স্থায়ী নয়।
ইসলামী জীবনদর্শনের মূলকথা হচ্ছে, দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী। আখিরাতের তুলনায় আমাদের পৃথিবীর জীবনকাল মাত্র কয়েক সেকেন্ড। মুস্তাওরিদ ইবনে শাদ্দাদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি— “আল্লাহর কসম! পরকালের তুলনায় দুনিয়ার উদাহরণ হলো যেমন তোমাদের কেউ সাগরের মধ্যে নিজের একটি আঙ্গুল ডুবানোর পর লক্ষ্য করে দেখুক আঙ্গুল কি পরিমাণ পানি নিয়ে আসল।” –মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৫৬
এই হাদীসে বুঝানো হয়েছে আঙ্গুলে উঠে আসা পানি এবং সাগরের পানি কম-বেশ হওয়ার ব্যাপারে যেমন, ইহকাল ও জান্নাতের তুলনা তেমন।
ইমাম ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন, “দুনিয়াটা মহান আল্লাহর নিকট নিতান্তই তুচ্ছ। তার প্রমাণ হলো, ঈমানদার মানুষ আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাকে কখনো অভুক্ত রাখেন। আর কাফিরকে অবিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও তৃপ্তি সহকারে তার খাবারের ব্যবস্থা করেন।
এই দুনিয়াতে আল্লাহতে অবিশ্বাসী বহু মানুষ খাবার খায়, পানীয় পান করে, সুন্দর পোশাক পরে, ভোগ বিলাসে মত্ত হয়। আবার অনেক বিশ্বাসী বান্দা আহার-পানীয়ের অভাব, পোশাক-পরিচ্ছদের অভাব ও বাসস্থানের ওভাব নিয়ে জীবন-যাপন করে।
একবার এক লোক ইমাম আহমাদ (রহ.)-এর সাক্ষাতে এসে বলল, ‘আমাকে কিছু নাসিহাহ (ওয়াজ) করুন।’ তিনি বললেন,
(১) যদি তুমি বিশ্বাস করো যে, আল্লাহই তোমার রিযিকের দায়িত্ব নিয়েছেন, তাহলে রিযিকের জন্য এত দুশ্চিন্তা কীসের?
(২) যদি দুনিয়া নশ্বরই হয়ে থাকে, তাহলে এখানে আত্মতৃপ্তি কেন?
(৩) যদি হিসাব-নিকাশ সত্যই হয়ে থাকে, তাহলে সম্পদ সঞ্চয়ের এত প্রবণতা কেন?
(৪) যদি সবকিছু আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে পূর্ব নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে এত ভয় আর শঙ্কা কেন?
তারপর লোকটি ইমাম আহমাদের কাছ থেকে বের হয়ে গেল এবং মনে মনে শপথ করল, সে সবসময় আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীরের ওপর সন্তুষ্ট থাকবে। –আল-মাদখাল, ৩/৩৫৭
সুখে থাকার জন্য এর চেয়ে উত্তম কথা আর কী হতে পারে? এই ৬টি কথা যদি আমরা সবসময় স্মরণে রাখতে পারি, তাহলে ভেবে দেখুন তো আপনার জীবন কতটা ঝুটঝামেলা মুক্ত হবে! কতটা প্রশান্তি বিরাজ করবে মনে!
পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহের মধ্যে আমাদের জীবনের হতাশা প্রতিরোধে অনেকগুলো আমল বর্ণিত হয়ে হয়েছে।
আমলগুলো নিন্মরুপ:
১) নামায আদায় : নামায হচ্ছে আল্লাহর সাহায্য লাভের সর্বপ্রথম ও প্রধান সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম। আল্লাহ বলেন- “তোমরা ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথেই রয়েছেন।” –সুরা বাকারা, আয়াত : ৪৫
“রাসুল (সা.) যখন কোনো সমস্যায় পড়তেন বা চিন্তাগ্রস্ত হতেন তখনই তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন।” –মুসনাদে আহমাদ : ৫/৩৮৮
আল্লামা শানকিতি বলেন, ধৈৰ্য্যের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা সুস্পষ্ট বিষয়। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলে এক সময় তার উপর আল্লাহ্র রহমত নেমে আসবে এবং সে সফলকাম হবে।
২) আল্লাহকে ভয় করা: দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্যের লাভের জন্য আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় করতে হবে। তাহলে আল্লাহ আমাদের জীবনের যাবতীয় সংকট নিরসন করে দেবেন।
আল্লাহ বলেন– “আর যে কেউ আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে আল্লাহ তার জন্য (উত্তরণের) পথ করে দেবেন। এবং তিনি তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে দান করবেন রিযিক।” –সুরা তালাক, আয়াত : ২-৩
৩) তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস বৃদ্ধি : তাকদিরের প্রতি আমাদের বিশ্বাস যতো বাড়বে, আমাদের জীবন ততো বিশুদ্ধ হবে। হতাশা ততো কমবে।
ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, নবীজি (স.) বলেছেন – “জেনে রেখো! পুরো উম্মত যদি তোমাকে সাহায্য করার জন্য একত্রিত হয়, তবে তারা ততটুকু করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্যে পূর্বেই লিখে রেখেছেন। আর যদি তারা কোন ক্ষতি করতেও একত্রিত হয়, তারা শুধু ততটুকু ক্ষতিই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং কিতাব শুকিয়ে গেছে।” –তিরমিযী, হাদিস নং : ২৫১৬; আহমাদ, হাদীস নং : ২৬৬৯
৪) আল্লাহর উপর ভরসা করা : ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যদি তোমরা আল্লাহর উপর যথাযথ ভরসা করতে তবে আল্লাহ্ তাআলা পাখির মত রিযিক দান করতেন। পাখি সকাল বেলায় ক্ষুধার্ত অবস্থায় বাসা থেকে বের হয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় উদরপূর্তি করে ফিরে আসে।” –মুসনাদে আহমাদ: ১/৩০, তিরমিয়ী: ২৩৪৪, ইবনে মাজাহঃ ৪১৬৪
৫) বেশী বেশী ইস্তেগফার করা: আমরা যদি আল্লাহর নিকট বেশী বেশী ইস্তেগফার করি আমাদের যাবতীয় সমস্যা সমাধান করে দেবেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: যে লোক সবসময় গুনাহ মাফ চাইতে থাকে [আস্তাগফিরুল্লাহ পড়তে থাকে] আল্লাহ তাকে প্রতিটি সংকীর্ণতা অথবা কষ্টকর অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ করে দেন, প্রতিটি দুশ্চিন্তা থেকে তাকে মুক্ত করেন এবং তিনি তাকে এমন সব উৎস থেকে রিযক দেন যা সে কল্পনাও করতে পারে না।” –আবূ দাঊদ, হাদিস নং : ১৫১৮; ইবনে মাযাহ, হাদিস নং : ৩৮১৯