ইমাম মুহাম্মদ ইবনে মাজাহ (রহ.)

হাদিস শাস্ত্রে যার অমর কীর্তি ও অবদান যুগ যুগ ধরে মানুষ স্মরণ করছে এবং বিশ্বের জ্ঞানপিপাসু মানুষ তৃষ্ণা মেটাচ্ছে, তিনি হচ্ছেন ইমামুল হাদিস আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াজিদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মাজাহ আল-কাজবিনি (রহ.)। ‘সুনানে ইবনে মাজাহ’ হচ্ছে তার শ্রেষ্ঠতম কীর্তি। হাদিসের ছয়খানা বিশুদ্ধ গ্রন্থের অন্যতম। গ্রন্থটি মুসলিম উম্মাহর জন্য সঠিক পথের দিশাস্বরূপ। 

ইমাম ইবনে মাজাহ ২০৯ হিজরি সনের ৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের প্রসিদ্ধ শহর ‘কাজবিন’ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। (মুজামুল বুলদান : পৃ. ৮২)। তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান (রা.) এর শাসনামলে ২৪ হিজরি সনে হজরত বারা ইবনে আজিব (রা.) এর নেতৃত্বে শহরটি মুসলিমদের দখলে আসে এবং হিজরি তৃতীয় শতাব্দীতে এ শহরটি হাদিস চর্চার কেন্দ্রভূমি হিসেবে গড়ে ওঠে। ফলে অসংখ্য মুহাদ্দিস ও ফকিহ এ শহরে জন্মগ্রহণ করেন কিংবা স্থায়ীভাবে বসবাস করে হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রে অনন্য অবদান রাখতে সক্ষম হন। 
ইবনে মাজাহ বাল্যকাল থেকে হাদিস শিক্ষা শুরু করেন। কাজবিনে কয়েকজন বড় মুহাদ্দিস ইলমে হাদিস দরস দিতেন। তাদের মধ্যে আলী ইবনে মুহাম্মদ আবুল হাসান তানাফেসি (রহ.), আমর ইবনে রাফে (রহ.), আবু হাজার বিজলি ইসমাইল ইবনে তাওবা (রহ.), আসু সাহল কাজবিনি (রহ.), হারুন ইবনে মুসা ইবনে হায়ান তামিমি (রহ.), ইবরাহিম ইবনে মুনজির (রহ.), মুহাম্মদ ইবনে আবু খালেদ আবু বকর কাজবিনি (রহ.) প্রমুখ বড় বড় মুহাদ্দিসের কাছ থেকে ইমাম ইবনে মাজাহ হাদিস শিক্ষা গ্রহণ করেন।
ইমাম ইবনে মাজাহ (রহ.) ২১-২২ বছর পর্যন্ত কাজবিনে হাদিস ও অন্যান্য শাস্ত্রে পা-িত্য অর্জন করেন। এরপর তিনি হাদিস শিক্ষা ও সংগ্রহের জন্য মক্কা, মদিনা, কুফা, বসরা, বাগদাদ, দামেস্ক, মিসর, খুরাসান, ইরাক, হিজাজ, সিরিয়া, তিউনিসিয়, হিমস, ইসপাহান, নিশাপুর প্রভৃতি স্থানে সফর করেন। তিন শতাধিক হাদিস বিশারদের কাছ থেকে হাদিস অধ্যয়ন করেন। তার প্রসিদ্ধ শিক্ষক হচ্ছেন হজরত মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে নুমাইর (রহ.), হজরত আবু বকর ইবনে শাইবাহ (রহ.), হজরত ইবরাহিম ইবনে মুনজির নিজামী (রহ.), হজরত হামদুন ইবনে উমরাহ মাগদাদী (রহ.), হজরত দাউদ ইবনে রশিদ (রহ.), হজরত জুবরাহ ইবনে মুফলিস (রহ.), হজরত মুহাম্মদ ইবনে রুমহ (রহ.), হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মুয়াবিয়া (রহ.), হজরত  হিশাম ইবনে উমরাহ জাওহারি (রহ.), হজরত আবু ইসহাক হারুবি (রহ.), হজরত  মুহাম্মদ ইবনে মুসান্না (রহ.) প্রমুখ। 
ইমাম ইবনে মাজাহ (রহ.) এর শিক্ষকদের মতো তার ছাত্রও রয়েছে অনেক। অনেক জ্ঞানী-গুণী মনীষী তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ধন্য হয়েছেন। তাদের মধ্যে আলী ইবনে সাঈদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-আসকারি (রহ.), ইবরাহিম ইবনে দিনার আল-জারশি আল-হামদানি (রহ.), আহমদ ইবনে ইবরাহিম কাজবিনি (রহ.), ইসহাক ইবনে মুহাম্মদ কাজবিনি (রহ.) মুহাম্মদ ইবনে ঈসা আসগর (রহ.) প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ইমাম ইবনে মাজাহ (রহ.) ছিলেন একজন প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ, বিজ্ঞ মুফাসসির ও বড় মাপের ইতিহাসবিদ। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থগুলো তাকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে রেখেছে। গ্রন্থগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হচ্ছে ‘আস-সুনান’। এ গ্রন্থে ৩২টি পরিচ্ছেদ ও ১ হাজার ৫০০ অধ্যায়ে ৪ হাজার ৩৪১টি হাদিস সন্নিবেশিত হয়েছে। তন্মধ্যে ৩ হাজার ২টি হাদিস সিহা সিত্তার অন্য পাঁচখানা গ্রন্থেও রয়েছে। আর ১ হাজার ৩৩৯টি হাদিস ইমাম ইবনে মাজাহ সংগ্রহ করেছেন। ‘সুনান’ গ্রন্থটি এক অনন্য গ্রন্থ। গ্রন্থটি হাদিস সংকলনগুলোর মধ্যে মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত।
ইমাম ইবনে মাজাহ (রহ.) ‘সুনান’ গ্রন্থটি রচনা কাজ সমাপ্ত করে তার ওস্তাদ আবু জুরাহ (রহ.) এর কাছে পেশ করেন। তখন আবু জুরাহ তা দেখে  মন্তব্য করলেন, ‘আমি মনে করি এ কিতাবটি লোকদের হাতে পৌঁছলে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রণীত সব বা অধিকাংশ হাদিস গ্রন্থই অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে।’
বস্তুত ইমাম জুরাহ (রহ.) এর ভবিষ্যদ্বাণী সার্থক ও সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এ গ্রন্থটি দুইটি দিক দিয়ে ‘সিহাহ সিত্তার’ এর মধ্যে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। প্রথমত, গ্রন্থটির রচনা, সংযোজন, সজ্জায়ন ও সৌকর্যে অতুলনীয়। গ্রন্থটিতে হাদিসের পুনরাবৃত্তি ঘটেনি। অন্য কোনো কিতাবে এ বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না। উপমহাদেশের খ্যাতনামা মুহাদ্দিস শাহ আবদুল আজিজ দেহলভি (রহ.) সুনানে ইবনে মাজাহর প্রশংসা করে বলেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে সজ্জায়ন, সৌন্দর্য ও পুনরাবৃত্তি ব্যতিরেকে হাদিসগুলো একের পর এক উল্লেখ করা, তদুপরি সংক্ষিপ্ত এবং বিশেষত্ব এ কিতাবে যেভাবে পাওয়া যায় অন্য কোনো গ্রন্থে তা পাওয়া দুর্লভ।’ (দেহলভি : বুস্তানুল মুহাদ্দিসিন, করাচি, আদব মঞ্জিল, প্রকাশিত ১৯৮৪ : ১১২)। হাফেজ ইবনে কাসির (রহ.) সুনানে ইবনে মাজাহ সম্পর্কে বলেন, ‘এ গ্রন্থটি অত্যন্ত কল্যাণপ্রদ। ফিকাহের দৃষ্টিতে এর অধ্যায়গুলো খুবই সুন্দর ও মজবুত করে সাজানো হয়েছে।’ (আল বায়েসুল হাদিসে ইলা মারেফাতে উলুমিল হাদিস : ১৯)। হাফেজ ইবনে হাজার আসকলানি (রহ.) বলেন, ‘ইমাম ইবনে মাজাহর সুনান গ্রন্থ অত্যন্ত ব্যাপক হাদিস সমন্বিত এবং অতি উত্তম।’
ইবনে মাজাহর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে এমন কিছু হাদিস উল্লেখিত হয়েছে, যা সিহাহ সিত্তার অন্য কোনো গ্রন্থে উল্লেখ হয়নি। এ কারণে সুনানে ইবনে মাজাহর ব্যবহারিক মূল্য অন্যান্য গ্রন্থের তুলনায় অনেক বেশি। আল্লামা আবুল হাসান সনদি (রহ.) বলেছেন, ‘গ্রন্থকার এতে হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) এর রীতি অনুসরণ করেছেন। বেশ ক’টি অধ্যায়ে এমন কিছু হাদিসের উল্লেখ করেছেন, যা অপর প্রখ্যাত পাঁচটি সহিহ গ্রন্থে পাওয়া যায় না।’ 
ইমাম ইবনে মাজাহর তাফসির গ্রন্থ হচ্ছে ‘আত-তাফসির’। এ গ্রন্থে তিনি কোরআনের তাফসির প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) এর হাদিস ও সাহাবিদের বর্ণিত বিবরণগুলো ইসনাদসহ বর্ণনা করেছেন। ইবনে মাজাহর ইতিহাস শাস্ত্রের গ্রন্থ হচ্ছে ‘আত-তারিখ’। এ গ্রন্থে সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে লেখকের সমসাময়িক যুগ পর্যন্ত সব রকমের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং গ্রন্থে তৎকালীন ইসলামী দুনিয়ার বিবরণ ও হাদিস বর্ণনাকারীদের অবস্থা আলোকপাত করেছেন। বর্তমানে এ গ্রন্থটি দুষ্প্রাপ্য।
ইমাম ইবনে মাজাহর ছিল খোদাভীতি এবং তিনি ছিলেন পরহেজগার। তিনি শরিয়তের বিধি-বিধান পালনে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ধর্মের মৌলিক বিষয়াদির শাখা-প্রশাখায় তিনি রাসুল (সা.) এর সুন্নাহর অনুসারী ছিলেন। কালজয়ী এই মহাপুরুষ হাদিস শাস্ত্রে যে অবদান রেখে গেছেন, তাতে তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন আজও। ইমাম ইবনে মাজাহ দীর্ঘদিন হাদিস, তাফসির ও ইতিহাস শাস্ত্রে খেদমত করার পর ২৭৩ হিজরি সনে, ৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে, রোজ সোমবার ৬৪ বছর বয়সে মহান রাব্বুল আলামিনের ডাকে সাড়া দেন। আল্লাহ তাকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন। 

Post a Comment

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

Previous Post Next Post