আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে পরীক্ষা
করার জন্য জাহান্নামের বহিরাবরণ চমৎকার
আকর্ষণীয় করে সাজিয়েছেন এবং জান্নাতের
বহিরাবরণে বিভিন্ন বাধাবিপত্তি ও বিপদাপদ
রেখেছেন। মানুষ কষ্টের বাধা ডিঙিয়ে, শ্রম ও
আয়াস স্বীকার করে, বিশ্বাসের প্রমাণ
হিসেবে জান্নাত অর্জনের চেষ্টা করবে এবং
জাহান্নামের সব আকর্ষণ উপেক্ষা করে
তাকওয়ার ওপর বহাল থাকবে। মহানবী হজরত
মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘দুনিয়া চাকচিক্যময় ও
সুমিষ্ট, দুনিয়াকে ভয় করো।’ (তিরমিজি)।
রাসুলে আকরাম (সা.) আরও বলেন, ‘দুনিয়ার
প্রীতি সব পাপের মূল’। (বুখারি শরিফ ও মুসলিম
শরিফ)।
প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) রমজানকে তিন
ভাগে ভাগ করেছেন। তিনি বলেছেন, রমজান
মাসের প্রথম দশক হলো রহমত; দ্বিতীয় দশক হলো
মাগফিরাত; শেষ দশক হলো নাজাত। নাজাত
মানে মুক্তি, মুক্তি পাওয়া, মুক্তি দেওয়া, মুক্ত
হওয়া। রমজানে শেষ দশকের নাজাতের অর্থ
হলো: এই দশকে মানুষ পাপ তাপ ও গুনাহ থেকে
মুক্ত হবে, জাহান্নাম থেকে মুক্ত হবে; পাপের
আকর্ষণ থেকে মুক্ত হবে। যেভাবে একজন
নেশায় আসক্ত বা নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি নির্দিষ্ট
সময়ের নির্দিষ্ট ওষুধপথ্য সেবন ও চিকিৎসার
মাধ্যমে নেশা থেকে মুক্তি লাভ করে থাকে।
মানবসত্তা বা ‘নফস’ অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ,
মদ, মোহ, মাৎসর্য এই ষড়্রিপুর সমন্বয়ে গঠিত
ব্যক্তিসত্তার তিন অবস্থা। যথা: নফসে
আম্মারা, নফসে লাউওয়ামা; নফসে মুতমাইন্না।
নফসে আম্মারা হলো পাপের প্রতি আকৃষ্ট নফস
বা অবাধ্য সত্তা। নফসে লাউওয়ামা হলো
অনুতপ্ত সত্তা; যে পাপ করে পেশা হিসেবে নয়;
নফসের তাড়নায়, শয়তানের ধোঁকায় বা
পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির শিকার
হয়ে এবং লজ্জিত, অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে।
নফসে মুতমাইন্না মানে হলো প্রশান্ত নফস, যার
পাপের প্রতি অনুরাগ থাকে না এবং নেকির
প্রতি আকর্ষণ থাকে।
নফসে আম্মারা বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন,
(হজরত ইউসুফ আ. বলেছেন,) ‘আর আমি আমার
নফসকে নির্দোষ বলি না, নিশ্চয় নফস অবশ্যই
মন্দ কাজের প্রতি নির্দেশ করে, আমার রব
যাকে রহম করেন তাকে ছাড়া; নিশ্চয় আমার রব
ক্ষমাশীল ও দয়ালু। (সুরা-১২ ইউসুফ, আয়াত-৫৩)।
নফসে লাউওয়ামা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা
বলেন, ‘শপথ কিয়ামত দিবসের আর শপথ নফসে
লাউওয়ামা’র। (সুরা-৭৫ কিয়ামা, আয়াত: ১-২)।
নফসে মুতমাইন্না সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার
ঘোষণা, ‘হে প্রশান্ত আত্মা! সন্তুষ্ট চিত্তে
তোমার রবের নিকট আসো এবং আমার
বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আমার জান্নাতে
প্রবেশ করো। (সুরা-৮৯ ফজর, আয়াত: ২৮-৩০)।
নফসে মুতমাইন্না হলো নফসের নির্মোহ অবস্থা;
এটাই হলো প্রকৃত মুক্তি বা নাজাত। মুমিনে
কামিল বা পরিপূর্ণ মুমিন হতে হলে রিপুগুলোকে
নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
মানুষের মধ্যে কিছু সদগুণ ও কিছু দোষ-ত্রুটি
সৃষ্টিগতভাবেই বিদ্যমান রয়েছে। আল্লাহ
তাআলা বলেন, ‘অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও
সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। সে সফল হলো
যে তাকে পবিত্র করেছে; আর সে ব্যর্থ হলো যে
তাকে কলুষাচ্ছন্ন করেছে।’ (সুরা-৯১ শামস,
আয়াত: ৮-১০)। নাজাতের অর্থ হলো ওই সব দোষ-
ত্রুটি থেকে নিজেকে মুক্ত ও পবিত্র করা এবং
সদগুণাবলিসমূহ অর্জন করে মুক্তির স্থায়িত্ব
নিশ্চিত করা। যাতে নফস মুতমাইন্না অবস্থা
থেকে পুনরায় লাউওয়ামা বা আম্মারার দিকে
ফিরে না যায়। রমজান মাস হলো মুক্তির মাস;
সকল প্রকার কলুষতা, মলিনতা, আবিলতা ও পাপ
পঙ্কিলতা থেকে নিজেকে মুক্ত করা বা মুক্ত
হওয়াই এই মাসের ব্রত বা সাধনা।
নাজাত বা মোহমুক্তির একটি উপায় হলো দূরে
সরে যাওয়া। ইতিকাফ নাজাতের চমৎকার
মাধ্যম। এতে বান্দা দুনিয়ার সব মোহ-মায়া
আকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে একান্তভাবে আল্লাহর
সান্নিধ্যে চলে যান। ইতিকাফ অবস্থায়
ইতিকাফকারী ফরজ ইবাদতের বাইরে কোনো
নফল ইবাদত না করলেও ইতিকাফের সওয়াব
পাবেন। তবে অতিরিক্ত নফল ইবাদত করলে আরও
বেশি ফজিলতের অধিকারী হবেন। যেমন:
কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করা, নফল নামাজ
পড়া, কাজা নামাজ আদায়, দোয়া-দরুদ পাঠ
করা, জিকির-আজকার করা, তাসবিহ তাহলিল
পাঠ করা। এ ছাড়া দিনি কথাবার্তা ও ধর্মীয়
জ্ঞানচর্চা করাও সওয়াবের কাজ। যেমন:
কোরআন-হাদিস, ফিকহ তাফসির ইত্যাদি পাঠ
করা ও তালিম করা। ইতিকাফ অবস্থায় এমন সব
কথা বলা ও কাজ করা বৈধ, যাতে কোনো গুনাহ
নেই। প্রয়োজনীয় সাংসারিক কথাবার্তা
বলতেও নিষেধ নেই; তবে অহেতুক অর্থহীন
কথাবার্তা দ্বারা ইবাদতের পরিবেশ নষ্ট করা
যাবে না। ইতিকাফকারী মসজিদের মধ্যে
ইতিকাফ ফেরত অবস্থায় সুগন্ধি ব্যবহার করতে
পারবেন এবং মাথায়, দাড়িতে ও চুলে তেল
লাগাতে পারবেন। মাথার চুলে ও দাড়িতে
চিরুনি করতে পারবেন। চোখে সুরমা লাগাতেও
পারবেন। (আল বাদায়ে ওয়াস সানায়ে)।
ইতিকাফ অবস্থায় ইতিকাফকারী প্রাকৃতিক
প্রয়োজনে, তথা অজু ইসন্তিঞ্জা পেশাব-
পায়খানা এবং খাবার আনার লোক না থাকলে;
খাবার আনার জন্য মসজিদের বাইরে যেতে
পারবেন এবং দ্রুততম সময়ে প্রয়োজন সেরে
ফিরে আসবেন। তবে মসজিদের বাইরে কারও
সঙ্গে কথাবার্তা বা সালাম বিনিময় করতে
পারবেন না; প্রয়োজনে তা ইশারা-ইঙ্গিতে
সারতে হবে। (আল ফিকহুল ইসলামি)।